“আপনার নামটা কী?”
“সেটা না-ই বা শুনলেন। পৈতৃক নামটা আমি একরকম ভুলেই গেছি। ব্যবহার করি না কিনা।”
“তবু একটা নাম তো মানুষের দরকার।”
“আজ্ঞে, আমাকে হারাধন বলেই ডাকবেন।”
“বেশ তো। তো হারাধনবাবু, আপনার রেটটা কিন্তু বড্ড বেশি। কবিতা পিছু একশো টাকা করে দিলে আমার থাকবে কী বলুন!
লোকটা ফের লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকে বলল, “দুলালবাবু যে রেট কমালে ভারি রাগ করেন।”
নন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “দুলালবাবুটা আবার কে?”
লোকটা ভারি অপ্রস্তুত হয়ে জিভ কেটে বলল, “নামটা ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ওটা ধরবেন না।”
“কিন্তু দুলালবাবু নামটা যে চেনা-চেনা ঠেকছে।”
হারাধন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে ভারি কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আজ্ঞে ও নামে মেলা লোক আছে। এই দুলালবাবু হলেন যে দুলাল পালমশাই। কবিতা মহাজন।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে, তাঁর কাছেই কবিতা সব মজুত থাকে কিনা। তিনি হলেন কবিতার একেবারে পাইকার।”
নন্দবাবু যদিও ভারি সরল-সোজা মানুষ, বু একথাটা তাঁর প্রত্যয় হল না। কেমন যেন একটু ধন্দ লাগল তাঁর, সন্দেহ হতে লাগল। এবং হঠাৎ লোকটার মুখোনাও তাঁর চেনা-চেনা ঠেকতে লাগল। এ হারাধন-টারাধন নয়। অন্য লোক। আর তোক বিশেষ সুবিধেরও নয়।
নন্দলাল একগাল হেসে বললেন, “তাই বলো। দুলাল পালমশাইকে আমিও খুব চিনি। ওই তো কাঠগুদামের পশ্চিমধারে দোতলা বাড়ি, সঙ্গে একটা মস্ত ঘেরা জায়গাও আছে। কতবার তাঁর বাড়িতে গেছি।
৮. লাল হেলমেটটা যেখানে ছিল
লাল হেলমেটটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই পড়ে আছে। একটু উঁচু ঢিবির ওপরে। জায়গাটা খুব সুনসান, নির্জন। চারদিকে ভয়ঙ্কর আগাছা দিয়ে ঘেরা। এখানকার বাঘা বিছুটির খুব বদনাম, তার ওপর বাবলার ঝোঁপঝাড়ও বেশ ঘন। এদিকপানে তাই কেউ আসে না।
ভুতো একটু দূর থেকে একটা গাছের ডালে উঠে হেলমেটটা দেখতে পেল। কিন্তু সেটা উদ্ধার করা যায় কীভাবে তা তার মাথায় এল না। উদ্ধার করার কাজটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। তার ওর ওটা হচ্ছে ভূতের সর্দারের সিংহাসন। উদ্ধার করতে গেলে কোন্ বিপত্তি ঘটে কে জানে। উদ্ধার না করলেও নয়। পরিদের দেশ থেকে ওইরকমই হুকুম পেয়েছে সে।
যে গাছটায় উঠেছে ভুতো সেটা একটা পুরনো শিশু গাছ। বেশ ঝুপসি। মেলা পাখির বাসা আছে। আর বাবুইয়ের বাসার মতো কীসব যেন ঝুলছেও ডাল থেকে। অথচ ঠিক বাবুইয়ের বাসাও নয়।
ভুতোর মাথার ওপরেই একটা ঝুলে আছে। ভুতো হাত পাড়িয়ে সেটা একটু ছুঁয়ে দেখল। কিছু বুঝতে পারল না। ধরে একটু টানাটানিও করল সে।
আচমকাই জিনিসটা ডাল থেকে খসে পট করে নীচে পড়ে গেল। আর তারপরই ধোঁয়ার মতো একটা বস্তুকে দেখা গেল নীচে। পাক খেয়ে ওপরে উঠে আসছে।
কিছু বোঝবার আগেই মাথায় খটাং করে একটা গাট্টা লাগল। ভুতো “বাবা রে” বলে এক হাতে মাথাটা চেপে ধরল। কিন্তু পর-পর আরও গোটাকয় রাম গাঁট্টা এসে জমল মাথায়।
গাঁট্টার চোটে হাত ফসকে নীচে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল ভুতোর। সে তাড়াতাড়ি নামবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাঁট্টা সমানেই চলছে। কে যে গাঁট্টা মারছে তা দেখা যাচ্ছে না।
গাঁট্টার চোটে অস্থির ভুতো চেঁচিয়ে উঠল, “কে রে তুই, পাজি হতচ্ছাড়া?”
কানের ওপর আর একটা গাঁট্টা এসে পড়ল, সেই সঙ্গে শোনা গেল একটা হেঁড়ে গলা, “আমি কে সেটা জানতে চাস? কেন, টের পাচ্ছিস না?”
ভুতো চেঁচিয়ে বলল, “ওঃ ভুতুড়ে গাঁট্টা মেরে খুব কেরানি দেখানো হচ্ছে? সাহস থাকলে সামনে আয় না। আমিও গাঁট্টা মারতে জানি।”
কথা শুনে কে যেন খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল, “বটে! তুইও গাঁট্টা মারবি? জানিস, আমার মতো গাঁট্টার ওস্তাদ ভূ-ভারতে নেই! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আদর করে আমার কী নাম দিয়েছিল জানিস? গেঁটে বাঁটুল।”
ভুতো বলল, “ওঃ, তুমি তো তা হলে পুরনো ভূত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তো আর আজকের লোক নন।”
“তা তো বটেই। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদারও অনেক বড়। গাঁট্টা মেরে লোককে ঢিট করতুম বলে মহারাজ আমাকে তাঁর সভায় চাকরি দিয়েছিলেন।”
“বটে?”
“বটেই রে। তবে কিনা লোকে ভারতচন্দ্র আর গোপালভাঁড়ের কথাই জানে, আমাকে কেউ চেনে না।”
গাঁট্টা থেমেছে। ভুতো মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতেও বলল, “তুমি গোপালভাঁড় আর ভারতচন্দ্রকে দেখেছ?”
“দেখব না মানে? রোজ দু’বেলা দেখা হত। কত গল্প হত, হাসিঠাট্টা হত।”
“তোমার গাঁট্টার বেশ জোর আছে বলতেই হবে। তবে কী জানো বাঁটুলদা, তুমি যে এখানে আছ, তা তো আমি জানতুম না।”
হেঁড়ে গলাটা এবার একটু নরম হল, “খুব লেগেছে নাকি তোর? তা কী করব বল। কয়েকশো বছর ধরে গুটি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছি। আরও হাজারখানেক বছরের আগে জাগবার ইচ্ছেই ছিল না। কাঁচা ঘুমটা ভাঙালি বলে চট করে মেজাজটা চড়ে গেল।”
“আমি ভেবেছিলুম বাবুইয়ের বাসা।”
বাঁটুল আর একটু নরম হয়ে বলল, “ঠিক আছে, গাঁট্টার যখন প্রশংসা করেছিস, তখন তোর কিছু উপকারও করব। বল, কী করলে তুই খুশি হোস!”
ভুতো হাতে চাঁদ পেল। একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বলল, “ওই যে ওখানে একটা লালমতো হেলমেট পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছ?”
“খুব পাচ্ছি।”
“ওইটে আমার চাই।”
“এই কথা! দাঁড়া এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।”
এই কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। তারপরই দেখা গেল লাল হেলমেটটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে ভুতোর একেবারে হাতের নাগালে এসে গেছে।