“ওই হল। নিজেকে ছোট ভাবতে নেই হে, বিনয়বশেও না। তুমি তো বি এস-সি আর এম এস-সি’তে সোনার মেডেলও পেয়েছিলে।”
“যে আজ্ঞে।”
“আর তারপরেই তোমার দম গেল ফুরিয়ে। সোনার মেডেল পাওয়া ছেলেদের যদি এই হাল হয়, তবে দেশের বিজ্ঞান কোথায় পড়ে আছে! ওদিকে জাপানিরা, মার্কিনিরা বিজ্ঞানে ধড়াধ্বড় এগিয়ে যাচ্ছে, আকাশে মানুষ পাঠাচ্ছে, যন্ত্রকে দিয়ে কথা কওয়াচ্ছে, আর তুমি মুখের ফেকো তুলো বিজ্ঞানের বক্তৃতা দিয়ে মাসে মাসে দু-পাঁচশো টাকা রোজগার করেই আহ্লাদে আটখানা! ছ্যা ছ্যা।”
রামলাল লজ্জায় দীনতায় মাথা নামিয়ে রইলেন।
ভুবন রায় অতিশয় কঠোর দৃষ্টিতে ছেলে দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “আমি লক্ষ্য করেছি, তোমার কোন নিজস্ব ল্যাবরেটরি নেই। কলেজের ল্যাবরেটরিতেও তুমি কদাচিৎ যাও। অর্থাৎ হাতে কলমে বিজ্ঞানচর্চার পাট তোমার উঠেই গেছে।”
“আজ্ঞে, তা-ই বটে।”
“সেই জন্যই তো বলছিলাম, ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। যে বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগার নেই, সে আবার কিসের বিজ্ঞানী?”
“যে আজ্ঞে।”
ভুবন রায় আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “তোমার বয়স অল্প, সুতরাং এগুলো নতুন করে সবই শুরু করা যায়। আমি ঠিক করেছি, আমাদের পুরনো গোয়ালঘরটা একটু সারিয়ে নিয়ে একটা পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেলব। গোয়ালটা বেশ লম্বা আর বড়। কাজের পক্ষে চমৎকার হবে।”
রামলাল ভারি অবাক হলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো বুকের বল খুঁজে না পেয়ে মিনমিন করে বললেন, “তার যে অনেক খরচ!”
ভুবন রায় অবিকল বন্দুকের আওয়াজ বের করলেন গলা দিয়ে, “খরচ! ভুবন রায় কবে খরচকে ভয় পেয়েছে শুনি! বিজ্ঞান-চেতনার অভাবে দেশটা উৎসন্নে যাচ্ছে। তুমি একটা গোল্ড মেডালিস্ট হয়েও দিন-দিন হাবাগে!বা হয়ে যাচ্ছ, আর আমি খরচের ভয়ে হাত গুটিয়ে থাকব?”
“আজ্ঞে, তা বটে।”
“বিজ্ঞান শিখেছিলে কি মুখস্থবিদ্যা জাহির করে মাসের শেষে দু’চারশো টাকা আয় করে উঞ্ছবৃত্তিতে জীবন কাটাবে বলে? আবিষ্কারকই যদি না হলে, তা হলে শিখে লাভটা হল কী?”
“যে আজ্ঞে।”
“তুমি কাল থেকেই লেগে পড়ো। কলকাতায় চলে যাও, যা-যা যন্ত্রপাতি লাগে, সব কিনে নিয়ে এসো। কাজে লেগে পড়ো। আমারও খানিকটা বিজ্ঞান পড়া আছে। তোমার অ্যাডভাইসার হিসেবে আমিও থাকব, হাতে-কলমে কাজ করব। এখনও কত কী আবিষ্কার করার আছে। এই ধরো না কেন, তোমার মায়ের তো খুব পান খাওয়ার নেশা, রোজ রাশি রাশি সুপুরি কুচোতে হয়। সুপুরি কুচোনোর একটা যন্ত্র যদি বানিয়ে ফেলতে পারো তো কত উপকার হয়। আমাদের হারু নাপতের চোখে ছানি আসছে, সেদিন ও আমার কানের ডগাটা প্রায় হেঁটে ফেলেছিল কাঁচি দিয়ে। ভাবছিলাম যদি চুল ছাঁটার একটা যন্ত্র তৈরি করা যায় তো মন্দ হয় না। জিনিসটা হবে অনেকটা হেলমেটের মতো, মাথায় পরে কিছুক্ষণ বসে থাকলেই চুল চমৎকার কাটা হয়ে যাবে। তারপর এরকম আরও কত কী বের করে ফেলা যায়। নিত্যি নতুন জিনিস আবিষ্কার করার আনন্দই আলাদা।”
“যে আজ্ঞে।”
“যাও, কাল থেকেই কাজে লেগে পড়ো। আর শোনো, ফিজিক্স, কেমিস্ত্রি, বায়োলজি সব রকম এক্সপেরিমেন্টের জন্যই যন্ত্রপাতি চাই। বুঝলে?”
“যে আজ্ঞে।” সুতরাং রামলালকে কলকাতায় যেতে হল। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে মেলা যন্ত্রপাতি এসে পড়ল। রামলাল মাসখানেক ভূতের মতো খেটে ল্যাবরেটরি সাজিয়ে ফেললেন।
ভুবন রায় ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা দেখে খুশি হয়ে বললেন, “শোনো হে রামলাল, প্রতি সপ্তাহে একটা করে নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে হবে, এইরকম একটা প্রতিজ্ঞা করে কাজে লেগে পড়ো। পিছনে আমিও আছি।”
রামলাল বেজার মুখ করে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
কিন্তু কী আবিষ্কার করবেন তা ভেবে ভেবে কূল পেলেন না। ভুবন রায় কিন্তু মহা উৎসাহে যন্ত্রপাতি নিয়ে তুমুল কাজে লেগে গেলেন।
একদিন হাতে একটা কাঁচের বাটি নিয়ে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এলেন ভুবন রায়। সবাইকে বাটির মধ্যে একটা কাদার মতো থকথকে জিনিস দেখাতে লাগলেন।
সবাই জিজ্ঞেস করল, “জিনিসটা কী?”
ভুবন রায় মাথা নেড়ে বললেন, “এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আর দুটো এক্সপেরিমেন্টের পরেই বোঝা যাবে।”
সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
পরদিনই ভুবন রায় ফের ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ করে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা টেস্ট টিউবের মধ্যে সবুজ তরল পদার্থ।
সবাই জানতে চাইল, জিনিসটা কী?
ভুবন রায় মৃদু হেসে বললেন, “বুঝতে পারবে হে, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে।”
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, ভুবন রায় অনেকগুলো জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। একটা কাঁচের গোলকের মধ্যে তিনটে কাঁচের গুলি, একটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দেখতে যন্ত্র, বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল। কিন্তু এগুলো দিয়ে কী হবে, তা আর কেউ জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না।
বিজ্ঞানীরা অনেক সময়ে এমন সব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেন, যা বস্তুত মানুষের কোন কাজেই লাগে না। এরকম একটা অর্থহীন বিখ্যাত আবিষ্কার হল জলিপাট্টি। জলিপাট্টি একটা পুডিং এর মতো জিনিস। কিন্তু মেঝেয় ফেলে দিলে কাঁচের মতোই ভেঙে যায়। আবার কোনও পাত্রে রেখে দিলে কিছুক্ষণ পর তা তরল হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা আজ অবধি একে কোনও কাজে লাগাতে পারেননি। আর একটা জটিল যন্ত্রও আবিষ্কার করা হয়েছিল, যার মধ্যে চালিত সমস্ত বিদ্যুৎ-প্রবাহই শূন্যে পর্যবসিত হয়। যন্ত্রটা আজও কোন কাজে লাগানো যায়নি। কিন্তু এইসব আবিষ্কার বিজ্ঞানচর্চার অবশ্যম্ভাবী কিছু লেজুড়।