কিন্তু বয়স তো কম হল না। দৌড়ঝাঁপ কি তার পোষায়?
ভুতোকে ধরার আশা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে পাঁচু, তখনই হঠাৎ ঝড়াক করে কে যেন তাকে শূন্যে তুলে নিল।
পাঁচুর এরকম অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। প্রথমটায় সে ভাবল মরে গিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল, মরেছে বলে মনে হল না, তা ছাড়া নীচে তার দেহটাও সে পড়ে থাকতে দেখল না। তা হলে হচ্ছেটা কী?
কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে থেকে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে খানিকক্ষণ হাঁপিয়ে নিল পাঁচু। তারপর চারদিকটা ভাল করে তাকিয়ে দেখল। ওই মিত্তিরদের পোড়ো ভিটে আর, ভৌত ক্লাব দেখা যাচ্ছে। নীচে জঙ্গল। ওপাশে গঞ্জ। দিনের আলোয় সব ফুটফুটে পরিষ্কার।
পাঁচু ঘাড় ঘুরিয়ে একটু দূরে ভুবনবাবুদের দোতলা বাড়িটাও দেখতে পেল। তা হলে এটা নিশ্চিত যে, সেমরেনি। তবে এই অশৈলী কাণ্ডটা হচ্ছে কেন? ভুবনবাবুও কাল রাত্তিরে আকাশে উঠে গিয়েছিলেন। কাণ্ডটা যে কী, তা বুঝতে পারছেনা পাঁচু। তবে সে কিছুক্ষণ হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করল। কাজ হল না। আকাশে ভেসে ভেসে খানিকটা দূরে এসেও পড়ল সে। সামনেই একটা মস্ত অশ্বথ গাছ।
উড়তে উড়তে গাছটার কাছ বরাবর আসতেইঝুপকরে কে যেন পাঁচুকে গাছটার মগডালের ওপর ফেলে দিন। বয়স হলেও পাঁচুর হাত-পা ভারি সচল। তার যা পেশা তাতে শরীরটা ঠিক রাখতেই হয়। তাই পড়েও পাঁচু হাত-পা ছরকুটে পপাত ধরণীতলে হল না। সামনে যা পেল তাই আঁকড়ে ধরে পড়াটা আটকাল।
কিন্তু যেখানে পড়েছে সেটা ভারি উঁচুতে একটা তেকাঠির মতো জায়গা। এখান থেকে নামা ভারি শক্ত। পাঁচু প্রথমটায় নামবার চেষ্টাও করল না। চুপচাপ বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিল। তারপর অবস্থাটা দেখল। অবস্থাটা মোটেই ভাল নয়। তার ওপর টানাহ্যাঁচড়ায় তার নকল দাড়িও খসে কোথায় পড়ে গেছে। ভারি দুরবস্থা। এখন আবার নতুন দাড়ি-গোঁফ না লাগিয়ে ভুবনবাবুর বাড়িতে ফিরেও যাওয়া যাবে না। অথচ আজ রাতে যে বাড়িতে আরও পেল্লায় ভোজ রয়েছে। কিন্তু সে কথা পরে। খুব সাবধানে পাঁচু গাছ থেকে নামবার চেষ্টা করতে লাগল।
জনার্দন আজ আর দেখাই দিচ্ছে না। আড়াল থেকে বলল, তোমার যে পিছু নিয়েছিল সে লোকটাকে চেনো?”
“না, জনার্দনদা। কে বলো তো!”
“সাঙ্ঘাতিক লোক। ভূত ধরার ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল প্রায়। ও হল পাঁচু মোদক!”
‘নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে।”
“খুব নামডাকওয়ালা লোক। সবাই চেনে। বিখ্যাত চোর।”
“চোর! বলো কী! কর্তাবাবার যে সর্বনাশ করে ছাড়বে! ও বাড়িতে এর একজন স্যাঙাত আছে।”
“সে আরও সাঙ্ঘাতিক লোক। তার নাম দুলাল সেন।”
‘দুলাল সেন! বলো কী! সে তো গুম হয়ে গেছে। ল্যাবরেটরিতে যে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হল সেদিন তারপর থেকে আর দুলালবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“দুলালবাবু সম্পর্কে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। তোমাদের ওসব ভুতুড়ে কাণ্ডের ফলে দুলালবাবু এখন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। তাঁর গায়ে এখন ভীষণ জোর, মাথায় নানা দুষ্টুবুদ্ধি।”
“যাঃ, দুলালবাবু তো ভীষণ ভিতু, গায়ে একটুও জোর নেই।”
“সেই দুলালবাবুর কথা ভুলে যাও। এই দুলাল সেন হল কালাপাহাড়।”
“বটে!”
“খুবই বটে!”
৭. নন্দলালবাবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর
নন্দলালবাবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘরে বসে বিমর্ষ মুখে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। ভুবনবাবু তাঁকে কবিতা লেখার আদেশ দিয়েছেন। বাবার হুকুম অমান্য কার সাধ্য এ বাড়ির কারও নেই, কিন্তু কথা হল, কবিতার সঙ্গে নন্দলালবাবুর কোনও সম্পর্কই নেই। ভুত-প্রেত, সাধন-ভজন, হোমিওপ্যাথি কবিরাজি ইত্যাদি হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু কবিতার লাইনে যে তিনি কিছুই জানেন না। কবিতা লিখতে হবে ভাবলেই তার হাত-পা শরীরের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইছে, ম্যালেরিয়ার মতো একটা কাঁপুনিও উঠছে আর মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে কী যেন নেমে যাচ্ছে। কবিতার চেয়ে বিজ্ঞান ঢের ভাল ছিল।
আরও ভয়ের কথা, ভুবনবাবুর কবিতা লিখতে শুরু করার আগেই সেই কবিতা কেনার জন্য কলকাতা থেকে দুই মূর্তিমান এসে হাজির হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, দু’লাইন কবিতা শুনে তারা দুশো টাকা আগাম দিয়েছে ভুবনবাবুকে। ফলে ভুবনবাবু রীতিমত খেপে উঠেছেন। খাওয়ার পর নন্দলাল সবে ঘরে এসে বিশ্রাম করার উদ্যোগ করছিলেন, এমন সময় ভুবনবাবু এসে ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়লেন।
“কাণ্ডখানা দেখেছ!”
“আজ্ঞে না, বাবা।”
“দুলাইন লিখতে-না-লিখতে দু-দুশো টাকা!”
“যে আজ্ঞে, এ তো খুব ভাল কথা!”
“ভাল কথা! শুধু ভাল কথা বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেই হবে? ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাইছে না কেন বলো তো! দু’লাইন লিখেই যদি দুশো টাকা হাতে আসে তা হলে হাজার-হাজার লাইন লিখলে কত আসতে থাকবে তার হিসেবটা মাথায় খেলছে না?”
নন্দলালবাবু মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে তা বটে।”
ভুবনবাবু অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, “ধরো, দিনে যদি তুমি এক হাজার লাইনও লিখে ফেলতে পারে তা হলে কত দাঁড়াচ্ছে?”
নন্দলালবাবু সতর্কভাবে একটু কেসে নিয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আমি কিন্তু শুনেছিলাম যে, ওঁরা দু’লাইনের জন্য দুশো টাকা হিসেবে দিচ্ছেন না। ওঁরা কবিতা পিছু দুশো টাকা দেবেন। তা সে কবিতা হাজার লাইনেরও হতে পারে।”