ভুবনবাবু বললেন, “আজ্ঞে, ঠিক তাই।”
“তবে মড়কের আর বাকি কী?”
“তা বটে।”
“দুটো লাইন তো লিখে ফেলেছেন দেখছি। আমি এক ফাঁকে লাইন দুটো পড়েও নিয়েছি।”
ভুবনবাবু সাগ্রহে বললেন, “কেমন হয়েছে বলুন তো!”
লোকটা ভারি আনমনা হয়ে অনেক দূরের দিকে চেয়ে থেকে আপনমনে ভরাট গলায় আবৃত্তি করল, “কলার কাঁদির মতো কবিতা ঝুলিছে গাছে-গাছে। পোষা বেড়ালের মতো কবিতা ফিরিছে পাছে পাছে। আহা! কী অপূর্ব!”
“বলছেন! সত্যিই অপূর্ব!”
লোটা গম্ভীরভাবে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে টেবিলের ওপর রেখে বলল, “আগাম।”
“আগাম, বলেন কী!” ভুবনবাবুর যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না।
লোকটা বলল, “নতুন কবিদের রেট একশো টাকা। কিন্তু আপনার এই কবিতাটার মাত্র দু’লাইন দেখেই বুঝতে পেরেছি আপনার ভিতরে কবিতার সমুদ্র রয়েছে। সেই সমুদ্র গর্জন করছে, যুঁসছে, বিরাট তরঙ্গ তুলে তেড়ে বেরিয়ে এসে সাহিত্যের জগৎকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। আপনি মশাই একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করেই ছাড়বেন না।”
ভুবনবাবু আনন্দে লাফিয়ে ওঠবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। বসা অবস্থায় লাফিয়ে ওঠা যায় না তো। কিছুক্ষণ আবেগটাকে দমন করে নিজেকে সামলালেন। তারপর গদগদ স্বরে বললেন, “দুপুরে আজ কী খাবেন বলুন তো?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের খাওয়া-দাওয়ার বায়নাক্কা নেই। নুনভাত ডালভাত হলেই হল। কালিয়া কোপ্তা খাওয়াতে চান তো তাও সই, আবার পোলাও মাংস খাওয়াতে চান তো তো তাও সই। তবে আমার এই সহকর্মীটির রোজ একটু ক্ষীর চাই। আর আমি নতুন গুড়ের পায়েসটা বেশ পছন্দ করি।”
“হবে। সব হবে। এখন চলুন একটু জলযোগ করে নেবেন।”
দু’জনে উঠল। খাওয়ার ঘরে বসে দু’জনে বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে-টেয়ে বলল, “না, কবি হলেও আপনার নজরটা বেশ উঁচু। এমনিতে বেশির ভাগ কবিই হাড়হাভাতে। সেইজন্যই কিছু হয় না। আপনার হবে।”
ভুবনবাবুআনন্দেমাথা নাড়তে নাড়তেদুখানা একশো টাকার নোট জয়পতাকার মতো ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ভিতর বাড়িতে গেলেন মান্যগণ্য লোক দুটির আপ্যায়নের জোরদার বন্দোবস্ত করতে। মাত্র দু’লাইন লিখতে-না-লিখতেই দু-দুশো টাকা এসে গেল। তা হলে যখন রাশি রাশি লিখবেন তখন তো টাকার বৃষ্টি হবে! শুরুতেই এরকম সাফল্য তো খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে।
.
ভুতো ক’দিন যাবৎ ভারি চিন্তার মধ্যে আছে। চিন্তা হল তার নিজেকে নিয়েই। তার বয়স নিতান্ত কম হলেও এর মধ্যেই তার বেশ কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। সে বুঝতে পারছে না, যা সব ঘটছে তা সত্যি ঘটনা কি না। পরিরা তাকে একবার একটা অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, আবার সেদিন জনাদন নিয়ে গেল ভূতের মিটিং-এ। এসবের মানে কী? আর ওই হেলমেটটারই বা রহস্য কী?
দুপুরবেলা আজ বেজায় ভোজের আয়োজন হয়েছে। দুটো দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোক এসে বুড়োকতার কবিতা কিনে নিচ্ছে, দুশো টাকা আগাম দিয়েছে। তাদের খাতিরে আজ বিয়েবাড়ির ভোজ। লোক দুটোকে খুব সুবিধের ঠেকল না ভুতোর। দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোক দেখলেই তার একটু সন্দেহ হয়। তার ওপর এ-লোকদুটোর ভাবগতিকও সন্দেহজনক। কিন্তু কিছু করারও নেই। এরা বুড়োকতার পেয়ারের লোক। একটা ভাল ব্যাপার হল, এদের খাতিরে খাওয়াটা আজ হল পেল্লায় রকমের। কিন্তু মনটা উড়ুউড়ু বলে জিভে তেমন স্বাদ পেল না ভুতো। দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোক দুটো অবশ্য সাঙ্ঘাতিক খেল। এত খাওয়া কাউকে কখনও খেতে দেখেনি সে। তবে আঁচানোর সময় দাড়ি-গোঁফওয়ালাদের একজন হঠাৎ হাঁ-হাঁ করে ওঠায় ভুতো দেখল লোকটার গোঁফ একদিকে খুলে ঝুলে পড়েছে। ভুত গাড় থেকে তার হাতে জল ঢেলে দিচ্ছিল। দৃশ্যটা দেখে ভারি অবাক হল সে। তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে গোঁফটা খপ করে ধরে একটানে ছাড়িয়ে আনল সে। দুষ্টুমি করে নয়, সে ঝুলন্ত গোঁফ দেখে এত অবাক হয়েছিল যে, টান মারার লোভ সামলাতে পারেনি।
এই বেয়াদপিতে লোকটা এক হাতে মুখ চাপা দিয়ে অন্য হাতে একটা পেল্লায় থাপ্পড় উঁচিয়ে বলল, “পাজি ছোঁড়া! দে গোঁফ!”
ভুতো আর দাঁড়ায়নি। দাওয়া থেকেলাফদিয়ে নেমে ছুটতে শুরু করেছে।পিছনে পিছনে গোঁফ-হারানো লোকটাও।
‘গোঁফ দে! গোঁফ দে! নইলে খুন করে ফেলব বলছি কিন্তু!”
ভুতো গোঁফ মুঠো করে ধরে হরিণের বেগে দৌড়চ্ছে।
ছুটতে ছুটতে জঙ্গলে ঢুকে পড়তেই কে যেন কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, “কী হয়েছে বলো তো! অমন ছুটছো কেন?”
গলাটা জনার্দনের। ভুত দৌড়তে-দৌড়তে বলল, “পিছনে যে লোকটা আসছে ওটা একটা ঠকবাজ। ওকে ধরো।”
“আর ছুটো না। ওই বেলগাছটার নীচে দাঁড়াও। আমাদের ওপর হুকুম আছে,
তোমার দেখাশোনা করার। আমি লোকটাকে ঢিট করছি।”
গোঁফ নিয়ে পাঁচু মোদকের সমস্যাটা পাঁচজনে বুঝবে না। এইসব ছদ্মবেশ টদ্মবেশ তার লাইনে নয়। সে সাদামাঠা চুরিটুরি করতেই ভালবাসে। এসব বাবুগিরি কি তার পোয়? কিন্তু দুলালবাবুর পাল্লায় পড়ে যা নয়, তা-ই করতে হচ্ছে। দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে এই সঙ সাজাবার কী যে দরকার ছিল, তা তার মাথায় ঢুকছেনা। তার ওপর এই দাড়ি-গোঁফে গাল-গলা ভারি কুটকুট করে। ছারপোকাও থাকতে পারে ভিতরে। তার চেয়েও বড় বিপদ আঁচানোর সময় জল লেগে আঠা আলগা হওয়ায় গোঁফ খুলে গেছে আর বদ ছোঁড়াটা গোঁফ নিয়ে পালিয়েছে। গোঁফ ছাড়া বাড়িতে আর ঢোকাও যাবে না।