“আপনারা কারা?”
“আমরা হলুম ‘সাপ্তাহিক নবযুগ’ পত্রিকার প্রতিনিধি। কবিতা খুঁজতে বেরিয়েছি। ভাল কবিতা দেখলেই কিনে ফেলি আমাদের বিখ্যাত পত্রিকার জন্য। তা শুনলুম এখানে নাকি খুব কবিতার চর্চা হচ্ছে।”
রামলাল দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “এ বাড়িতে কস্মিনকালেও কবিতার চচা হয়নি। তবে হবে। কিন্তু সে যে কী জিনিস হবে, তা ঈশ্বর জানেন।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “জিনিস আমরা চিনি। শুনুন মশাই, আমাদের নগদ কারবার। কবিতা পছন্দ হলেই আমরা এক-এক কবিতা একশো টাকায় কিনে নেব। একেবারে নগদ টাকা ফেলে।”
“বলেন কী! প্রতি কবিতায় একশো টাকা?”
“তেমন–তেমন কবিতা হলে দু’গুণ টাকা। অর্থাৎ দুশো।”
রামলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “তা হলে আপনারা আমার বাবার সঙ্গে দেখা করুন।”
“আরে, দেখা করতেই তো আসা। চলুন। শুভস্য শীঘ্রম।”
রামলাল বিস্ময়ে ঘনঘন মাথা নাড়তে নাড়তে দু’জনকে ভুবন রায়ের সামনে এনে হাজির করলেন।
সকালে জলখাবারটি খেয়ে ভুবনবাবু কাগজ কলম নিয়ে বাগানে টেবিল চেয়ার পেতে বসেছেন। নিমের ছায়ায় চিকড়ি-মিকড়ি রোদে শীতের সকালে বসে তিনি কবিতা লেখার জন্য অনেকক্ষণ ধরে কসরত করার পর একটা মাত্র লাইন লিখতে পেরেছেন। কলার কাঁদির মতো কবিতা ঝুলিছে গাছে-গাছে। পোষা বেড়ালের মতো কবিতা ফিরিছে পাছে পাছে।
প্রথম কবিতাটা কবিতা বিষয়ে লেখা ভাল। কিন্তু কবিতাকে বিষয় করে লেখা যে বেশ শক্ত, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ভুবনবাবু। দামি পাকার কলমে পেছনটা কামড়ে কামড়ে প্রায় ক্ষতবিক্ষত করে ফেললেন। মাথার চুলও বার বার টানাটানি করায় কয়েক গাছি ছিঁড়ে গেল। উঠে পায়চারি করে নিলেন বারকয়েক। বিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কার করেই যেমন আর্কিমিডিসির মতো ইউরেকা’ বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে বেরিয়ে আসতেন, কবিতায় তেমনই আদি কবি বাল্মীকির মতো এক লাইন লিখেই তিনি বার কয়েক বলে ফেলেছেন “কিমিদং কিমিদং!”
ভুবনবাবু যখন দ্বিতীয় পঙক্তির সন্ধানে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ব্যথা করে ফেলেছেন সেই সময়ে রামলাল এসে সামনে দাঁড়িয়ে বিনীত স্বরে ডাকলেন, “বাবা।”
ভুবনবাবু খাড়া হয়ে বসে বললেন, “খাতাটাতা সব এনেছ তো! কালির বোতল! ডিকশনারি! কবিতার বই?”
“আজ্ঞে সেসব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আপনি কবিতা লিখছেন শুনে এই এঁরা সব কলকাতা থেকে এসে পড়েছেন।”
ভুবনবাবু এবার দাড়ি আর চশমাওলা লোক দুটোর দিকে তাকালেন। শশব্যস্ত বলে উঠলেন, “বিদেয় করে দাও, বিদেয় করে দাও। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।”
“আজ্ঞে এঁদের বিদেয় করাটা যুক্তিযুক্ত হবে না। এঁরা সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকার লোক, কবিতা কিনতে বেরিয়েছেন। এক-একটা কবিতা একশো থেকে দু’শো টাকা।”
ভুবনবাবু নড়েচড়ে বসে বললেন, “বটে! তা নেহাত খারাপ ব্যাপার তো নয়। বসতে দাও ওঁদের।”
রামলাল তাড়াতাড়ি চেয়ার-টেবিল আনিয়ে দু’জনকে ভুবনবাবুর মুখোমুখি বসালেন। দাড়ি ও চশমাওলা দু’জন গম্ভীর মুখে বসলেন। তারপর দুজনের একজন বললেন, “আমরা কবিতার খোঁজে বেরিয়েছি। ভাল কবিতা পেলে মোটা টাকায় কিনে নেব।”
ভুবনবাবু বিগলিত মুখে বললেন, “নবযুগ তো বিখ্যাত কাগজ।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। দেড়-দু’লাখ সার্কুলেশন। একটা কবিতা কোনওক্রমে ছাপতে পারলেই রাতারাতি বিখ্যাত।”
“ও বাবা, তা আমিও কবিতা লিখি বটে, কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“ইয়ে মানে এখনও ব্যাপারটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি আর কি।”
লোকটা খুব মিষ্টি করে বলল, “ওরকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। কবিতা কি সোজা জিনিস। অনেক ধৈর্য অনেক অধ্যবসায়ে হয়। তাও প্রতিভা না থাকলে শত চেষ্টাতেও হয় না।”
“আজ্ঞে তা তো বটেই।”
“আপনি কি এক-আধটা কবিতা শোনাতে পারেন আমাদের?”
“বিলক্ষণ! কবিতা শোনাব এ তো আনন্দের কথা। তবে আপনারা অনেক দূর থেকে আসছেন, একটু বিশ্রাম-টিশ্রাম করলে হয় না? ধরুন, একটু জলখাবারেও বন্দোবস্ত করা উচিত। তা উঠেছেন কোথায়?”
লোটা মাথা নেড়ে বলল, “কোথাও উঠিনি। সবে গাড়ি থেকে নেবে ঘুরে টুরে দেখছি আর কি। হোটেল-টোটেল খুঁজে নিতে হবে।”
ভুবনবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “ছিঃ ছিঃ, আমি থাকতে হোটেলে উঠবেন, তাই কি হয়? ওরে কে আছিস…”
ভুবনবাবু হাঁকডাকে বাড়িতে একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। এক তলার সবচেয়ে ভাল ঘরখানা ঝাড়পোঁছ করে কাজের লোকেরা ঘরটাকে ঝকঝকে করে তুলতে লেগে গেল। রান্নাঘরে গাওয়া ঘিয়ের লুচি আর আলুর দমের ব্যবস্থা হতে লাগল। গরম চা এসে গেল।
নবযুগের লোক দুটো বেশ নিশ্চিন্ত মনে চা খেতে-খেতে ঠ্যাঙ নাচাতে লাগল। মুখপাত্র লোকটি চা শেষ করে ভুবনবাবুর দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল, “আপনার হবে।”
ভুবনবাবু হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “কী হবে?”
“কবিতা।”
“বলছেন! সত্যিই বলছেন! কী করে বুঝলেন?”
“এই কম্ম করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললাম। কবিতা না শুনেও বলে দিতে পারি কোন লোকটার ভিতরে কবিতার মালমশলা আছে।”
ভুবনবাবু ভারি তৃপ্ত হয়ে বললেন, “সেটা আমিও টের পাচ্ছি। আমার চারদিকটা যেন কবিতায় একেবারে ঠাসা। কবিতার যেন একেবারে মড়ক…ইয়ে…না….মড়ক কথাটা ঠিক জুতসই হল না–”
লোকটা হাত তুলে ভুবনবাবুকে বাড়া দিয়ে বলল, “কিছু ভুল বলেননি। মহামারী থেকেই মড়ক লাগে। আপনি চারদিকে জীবাণুর মতো কবিতার ভিড় দেখতে পাচ্ছেন তো!”