“বিজ্ঞান একটা যাচ্ছেতাই জিনিস। যার কাণ্ডজ্ঞান আছে সে কখনও বিজ্ঞানচর্চা করবেই না। বিজ্ঞানই দুনিয়াটাকে রসাতলে দিচ্ছে।”
“কিন্তু আপনি যে অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার করেছেন তার জন্য ইতিমধ্যেই চারদিকে হইচই পড়ে গেছে। লোকে বলছে, আপনি আগামী পৃথিবীর চেহারাই পালটে দেবেন।”
“শোনো হে বাপু, ঈশ্বর আমাকে মেলা প্রতিভা দিয়েছেন। আমি যদি ফুটবল খেলতুম, তা হলেও মারদাঙ্গা বা পালু হতে পারতুন
রিপোর্টার একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “মারদাঙ্গা আর পালু কে বলুত তো?”
ভুবনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন, ওই যে দু’জন বিশ্ববিখ্যাত খেলুড়ে–খুব নাকি ভাল খেলে!”
“ওঃ! মারাদোনা আর পেলের কথা বলছেন কি?”
“তাই হবে। কথা হল, যার প্রতিভা আছে সে বিজ্ঞানেও যেমন, কবিতাতেও তেমন, ফুটবল ক্রিকেটেও কেউকেটা। বুঝলে।”
“আজ্ঞে তা তো বটেই।”
“প্রতিভা বড্ড বেশি হয়ে যাওয়ায় খানিকটা চলকে ওই বিজ্ঞানে গিয়ে পড়েছিল। তবে যা হওয়ার হয়েছে। বিজ্ঞানের ছায়াও আমি আর মাড়াচ্ছি না।”
রিপোর্টার মাথাটাথা চুলকে বলল, “সার, একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন
তো! আমি রিপোর্টার মানুষ, যখন-তখন যেখানে-সেখানে ছুটতে হয়। তাই বলছিলাম, বিজ্ঞান যখন ছেড়েই দিচ্ছেন তখন ওই যন্ত্রটাঘদি আমাকে দান করেন।”
ভুবনবাবু চমকে উঠে বললেন, “ওই সব্বনেশে জিনিস তুমি চাইছ? তুমিও তো দেখছি সব্বনেশে লোক! ওই যন্ত্র আমি রামলালকে গুড়ো করতে দিয়েছি। গুঁড়ো করে অ্যাসিডে ছড়িয়ে সাত হাত মাটির তলায় পুঁতে ফেলা হবে।
“ইস, বড্ড লস হয়ে গেল সার। দেখি যদি এখনও গুঁড়ো করা না হয়ে থাকে–” বলে রিপোর্টার দৌড় লাগাল।
রামলাল অবশ্য যন্ত্রটাকে গুঁড়ো করেননি। তিনি ল্যাবরেটরিতে বসে খুব মন দিয়ে যন্ত্রটাকে নানাভাবে পরীক্ষা করছিলেন। বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট কিছু ধারণা আছে। কিন্তু কোনও ধারণা দিয়েই তিনি যন্ত্রটার রহস্য ধরতে পারছিলেন না। বলতে কি, যন্ত্রটার মধ্যে তেমন জটিল কলকজা কিছুই নেই। একনজরে ছেলেমানুষি কাটুমকুটুম বলেই মনে হয়। অথচ তাঁর বাবা ভুবনবাবু এই যন্ত্রে ভর করেই আকাশে উঠে গিয়েছিলেন কী করে সেটা সম্ভব হল তা রামবাবু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না।
সকালবেলা তিনি খবর পাঠিয়ে কলেজের আর কয়েকজন বিজ্ঞানের অধ্যাপককে ডাকিয়ে এনেছেন। তাঁরা অবশ্য ভুবন রায়ের গগনবিহারের খবর জানতেন। দু একজন নিজের চোখেই ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরাও ভারি ভাবিত এবং অপ্রস্তুত বোধ করছেন।
ফিজিক্সের গুণময়বাবু বললেন, “বিজ্ঞানের যে আমরা এখনও কিছুই জানি এই যন্ত্রটা তা-ই প্রমাণ করছে।”
অঙ্কের শৈলেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “আমার মনে হচ্ছে, এটা বিজ্ঞান টিজ্ঞান নয়। এ হল যোগ। ভুবনবাবু যোগবলে শূন্যে উঠেছিলেন। আমার বাবার
এক মেসো প্রায়ই এরকম উঠে যেতেন।”
কেমিস্ত্রির প্রসাদবাবু যন্ত্রটা দেখেশুনে বললেন, “আমাদের উচিত ব্যাপারটা সায়েন্স কংগ্রেসে জানানো।”
রামলাল বললেন, “আপনারা আর একটু বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। আমার বাবা বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না। বুড়োবয়সে তাঁকে কিছু ছেলেমানুষিতে পেয়েছে। তবে অনেক সময়ে নিতান্ত অবিজ্ঞানীর হাতেও হঠাৎ করে কিছু একটা আবিষ্কার ঘটতে পারে। কিন্তু এ-যন্ত্রটা লক্ষ্য করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, এর মধ্যে তেমন কিছু নেই। সকাল থেকে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও আমি বহুবার এই যন্ত্রটার সাহায্যে ওড়বার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। বাবা তা হলে কীভাবে উঠলেন?”
শৈলেনবাবু ফের বললেন, “যোগ।” বিজ্ঞানীরা অনেকক্ষণ ভাবলেন এবং যন্ত্রটাকে নানাভাবে পরীক্ষা করলেন। অবশেষে প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর স্বীকার করলেন যে, সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম বা বিজ্ঞানের ধর্ম অনুযায়ী যন্ত্রটাকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
রামলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এই যন্ত্রটা আবিষ্কারের ফলে অবশ্য একটা উপকার হয়েছে। বাবা বিজ্ঞান ছেড়েছেন এবং আমিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু বাবার মাথায় নতুন যে আইডিয়া এসেছে সেটা আরও সাঙ্ঘাতিক।”
সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, “কী সেটা?”
“উনি এখন কবিতা লেখার দিকে ঝুঁকেছেন। বাজারে খাতা কিনতে লোক পাঠানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, উনি চান আমিও বিজ্ঞান ছেড়ে কবিতা লিখতে শুরু করি।”
ফিজিক্স গম্ভীর হয়ে বললেন, “কবিতা! সে তো খুব খারাপ জিনিস।”
অঙ্ক বললেন, “অতি বিচ্ছিরি, কিছুই বোঝা যায় না।”
কেমিষ্ট্রি বললেন, “কবিতা দেখলেই আমার মাথা ঘোরে।”
রামলাল বিরস বদনে বললেন, “তা হলে আমার অবস্থাটা কীরকম তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।”
“হনুমানের মতে, শৈলেনবাবু বললেন। রামলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর দুর্দশায় সমবেদনা জানিয়ে সহকর্মীরা বিদায় হওয়ার পর রামলাল একা বসে ফের চিন্তা করতে লাগলেন। ভুবনবাবু বিজ্ঞানের বাতিক খুবই অস্বস্তিকর ছিল বটে, কিন্তু কবিতা ঘাড়ে চাপলে কি আর রামলাল বাঁচবেন! আবার তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
এমন সময় কে যেন বলে উঠল, “তা কবিতাও তেমন খারাপ জিনিস নয়! কবিতা দিয়েও কত কী হয়!”
রামলাল চমকে উঠে বললেন, “কে?” ||||||||||
দাড়িগোঁফওয়ালা কালো চশমা চোখে একটা লোক আর-একজন দাড়িগোঁফওয়ালা চশমা চোখে লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকে ভারি অমায়িক হেসে বলল, “এই আমরাই কথাটা বলছিলুম।”