ভুবনবাবু অতিশয় উদার গলায় বললেন, “ওহে রামলাল, তোমার কবিতা টবিতা আসে?”
“আজ্ঞে না।”
ভুবনবাবু বিরক্তিতে ক্রু কুঁচকে বললেন, “বিজ্ঞান শিখে একেবারে গোল্লায় গেছ। কবিতা হল গিয়ে পৃথিবীর একেবারে যাকে বলে সব। কবিতা যদি বুঝতে না পারে তা হলে জীবনটারই অর্থ তোমার বোঝা হল না।”
“যে আজ্ঞে।”
“আমি বলি কি, আজ থেকেই তুমি কবিতার একটা হেস্তনেস্ত করতে লেগে যাও। এখনই বাজারে গিয়ে সবচেয়ে মোটা বাঁধানো খাতা গোটা দশেক আমার জন্য আর গোটা দশেক তোমার জন্য কিনে আনেনা। নন্দ আর শ্যামকেও জিজ্ঞেস করে দ্যাখো। চায় তো ওদের জন্যও খানকয়েক খাতা এনে দিও, আর কয়েক বোতল কালিও লাগবে। বইয়ের দোকানে গিয়ে যে ক’খানা কবিতার বই পাবে নিয়ে আসবে। আর ছন্দটল শেখার বই পাওয়া যায় না?”
“খুঁজে দেখতে হবে।”
“দেখো। না পাওয়া গেলে কলকাতায় চিঠি লিখে ওসব বইও আনিয়ে নাও। আর ভাল দেখে কয়েকটা ডিকশনারি।”
“যে আজ্ঞে।”
“আর শোনো।”
“যে আজ্ঞে।”
“রবীন্দ্রনাথ যে পোশাক পরতেন সেটা লক্ষ্য করেছ?”
“রবীন্দ্রনাথ একটা জোব্বা পরতেন।”
“হ্যাঁ। ওরকম জোব্বাও গোটাকয়েক তৈরি করাতে হবে। ভাল দেখে রেশমি কাপড় কিনে আমার আর তোমাদের তিন ভাইয়ের মাপে অন্তত চারটে করে জোব্বা আজই ইরফান দর্জিকে তৈরি করতে দিয়ে এসো।”
“যে আজ্ঞে।”
রামলালকে বিদায় দিয়ে ভুবনবাবু একটু বাগানে এলেন। অনেক গোলাপ ফুল ফুটে আছে। তিনি একটি রক্তগোলাপ তুলে নিয়ে গন্ধ শুকলেন। ফুল, চাঁদ, পাখির ডাক, প্রকৃতি এসব না হলে কবিতার মেজাজ আসে না।
ভুবনবাবু বাগানে পায়চারি করতে করতে ফের টের পেলেন তাঁর চারদিকটায় জীবাণুর মতো কবিতা গিজগিজ করছে। কবিতা দিয়েই যেন ভগবান দুনিয়াটাকে বানিয়েছেন। তাঁর হাত কবিতা লেখবার জন্য নিশপিশ করতে লাগল।
সমস্যা হল, জীবনে একমাত্র পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আর তিনি কবিতা-টবিতা কখনও বিশেষ পড়েননি। কবিতা জিনিসটা যে নিতান্তই বাহুল্য জিনিস, তা তিনি এককালে বেশ জোর গলাতেই প্রচার করতেন।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নন্দলালবাবুর ঘরের সামনে এসে পড়েছেন। ভেজানো দরজায় টোকা দিয়ে বললেন, “ওহে নন্দলাল, ঘরে আছ নাকি?”
নন্দলাল ঘরেই ছিলেন। প্রাতঃকালে এই সময়টায় তিনি প্রাণায়াম করেন। ভুবনবাবুর গলা পেয়ে তটস্থ হয়ে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
ভুবনবাবু ঘরে ঢুকে নন্দলালকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ও কী! ব্যায়াম করছ নাকি? ছিঃ ছিঃ, ব্যায়াম করা যে খুব খারাপ অভ্যাস হে?” ওতে মনটা শরীরের দিকে চলে যায়। মাথায় সূক্ষ্ম ভাবনাচিন্তা আসতে চায় না, ব্যায়াম করলে কবিতা লিখবে কী করে?”
নন্দবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না। তবে মৃদু গলায় বললেন, “কবিতা! আমি তো কবিতা-টবিতা লিখি না। কবিতা খুব খারাপ জিনিস। কবিতা লিখলে ধর্মভাব নষ্ট হয়ে যায়।”
ভুবনবাবু গম্ভীর হয়ে অত্যন্ত থমথমে গলায় বললেন, “তোমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনব বলে আশা করিনি। শুনে মর্মাহত হলাম। কবিতা সম্পর্কে তোমার মনোভাব অত্যন্ত নিন্দনীয়। জানো, কবিতা দিয়েই ভগবান দুনিয়াটাকে বানিয়েছেন? যদি দেখার চোখ থাকত তা হলে দেখতে পেতে আকাশে বাতাসে কবিতারই অনুরণন হচ্ছে। আমি তো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।”
নন্দলালবাবু ভারি বোকাঁপানা মুখ করে চেয়ে রইলেন। ভুবনবাবুর মুখে কবিতার প্রশংসা শোনার মতো অবাক কাণ্ড আর কী আছে?
ভুবনবাবু নিমীলিত নয়নে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, “শুধু শোনা কেন, দেখতেও পাওয়া যায়। আজ সকালে কী দেখলুম জানো? দেখলুম, আকাশে কবিতার ঘুড়ি উড়ছে হাজার-হাজার। গাছের ডালে ডালে বানরের মতো স্কুল খাচ্ছে কবিতা। জীবাণুর মতো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কবিতা।”
নন্দলালবাবু ‘খ্যঙ’ করে একটা শব্দ করলেন।
“কিছু বললে নন্দলাল?”
“আজ্ঞে না।”
“একটা শব্দ শুনলুম যেন! যাকগে। যা বলছিলুম, কবিতা বোঝবার, কবিতা দেখবার চোখ চাই। ওসব ব্যায়াম-ট্যায়াম করো বলেই তোমার কবিতার অনুভূতিটা তেমন হচ্ছে না। আমি রামলালকে খাতা আনতে পাঠিয়েছি। আজ থেকেই কবিতা মকসো করতে বসে যাও। এমন কিছু শক্ত ব্যাপারও নয়। একটু একটু করে ভাববে আর লিখবে।”
নন্দবাবুর মুখে আর শব্দ নেই। চোখের পলক পড়ছেনা। খানিকক্ষণ বস্ত্রহাতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
এদিকে রাতের ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ায় ভোর হতে না হতেই . দলে দলে লোক এসে বাড়িতে ভিড় করে ফেলল। তাদের মধ্যে খবরের কাগজের লোকও আছে।
ভুবনবাবু ভারি বিরক্ত হয়ে চাকরকে ডেকে বলেছিলেন, “ওরে, ওদের বলে দে, আমার শরীর খুব খারাপ, দেখা হবে না।”
একজন রিপোর্টার কয়লাওয়ালা সেজে ঢুকে পড়েছে, সে এসে জানলায় উঁকি দিয়ে বলল, “অভিনন্দন ভুবনবাবু, আমাদের কাগজের জন্য ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ না দিলেই নয়।”
ভুবনবাবু ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, “হবে না, আমার শরীর খুব খারাপ।”
“ইন্টারভিউ নিতে না পারলে আমার চাকরি থাকবে না।”
“চাকরি ছেড়ে কবিতা লেখো। কবিতার মতো জিনিস হয় না।”
“বলেন কি, আপনি কি কবিতারও ভক্ত? বিজ্ঞান আর কবিতাকে কীভাবে মেলাচ্ছেন সার?”
“মেলাচ্ছি না হে। বিজ্ঞান ছেড়ে কবিতা ধরেছি, কবিতা ছাড়া দেশের উন্নতি নেই।”
লোকটা খসখস করে নোটবইতে ভুবনবাবুর এসব কথা লিখে নিতে নিতে বলল, “বিজ্ঞান কেন ছাড়লেন তা যদি দু-এক কথায় বলেন!”