ভুবনবাবু একটু চাপা গলায় বললেন, “ভগবানকে কথাটা বলার এখন দরকারটাই বা কী দৈববাণী? সব কথা কি তাকে বলা ভাল?”
“আরও মুশকিল কী জানেন, লোকে তাঁকে অন্তর্যামী বলে বটে, আসলে তিনি অত খোঁজখবর রাখেন না, এই আমরা তাঁর চেলা চামুণ্ডারাই তাঁকে গিয়ে যা সব খবরটবর দিই আর কি। কিন্তু তা হলে আপনার মতো একজন গণ্যমান্য লোকের খবর তো আর চেপে রাখা যায় না। আমি গিয়ে হাজির হলেই প্রথমেই তিনি আপনার খবরই জানতে চাইবেন যে।”
“নাঃ, বড় মুশকিল হল দেখছি।”
“আজ্ঞে, মুশকিল একটু আছে। তিনি যদি জানতে পারেন যে, আপনি বিজ্ঞান ছেড়ে দিচ্ছেন তা হলে হয়তো তিনি কলকাঠি নেড়ে ফের আপনাকে বিজ্ঞানের দিকেই ঠেলে দিকটা খুলে দেবেন।”
“অ্যাঁ! ওরে বাবা! কিন্তু আমার যে ভয়ঙ্কর বিজ্ঞানভীতি হয়েছে হে দৈববাণী! ফের বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে আমি যে মারা পড়ব। কোনও উপায় হয় না?”
“তা কি আর হয় না মশাই। হয়। তবে কিনা খরচাপাতিও তত বড় কম হবে না। প্রণামীটা একটু মোটা করে ফেললে ভগবান হয়তো খুশি হয়ে বিজ্ঞানটা মকুব করে পদ্যের দিকটা খুলে দেবেন। গুছিয়ে কথাটা বলতে হবে, এই যা।”
“সে তো খুবই ন্যায্য কথা হে। তা প্রণামীটা কত হলে হয় বলে তো!”
“তা ধরুন গিয়ে লাখ পাঁচেক।”
“ও বাবা, সে যে অনেক টাকা।”
“কাজটাও তো শক্ত। না হয় হাজার পাঁচেক কমই দেবেন।”
“তাতেও অনেক রয়ে গেল।”
“তা আপনি একটা দর রাখুন। “ধরো, যদি হাজার-পাঁচেক দিই?”
“না মশাই, সেটা বড় খারাপ দেখাবে। আসলে ওসব হাজার ফাজার ভগবানের চোখেই পড়ে না।”
“ধরো আরও হাজার পাঁচেক যদি দিই!”
“আর একটু উঠুন।”
“ওঠার কথা আর বোলো না হে দৈববাণী। উঠতে আজকাল যে-আমি বড় ভয় পাই। একটু আগেই তো দেখলে ওঠার কী সাঙ্ঘাতিক ঝক্কি।”
“টাকাটা বড় কথা নয় ভুবনবাবু। আর ভগবানেরই বা টাকাপয়সা কোন কাজে লাগবে? আসল কথাটা হল নজরটা ছোট করতে নেই। কে কত দিল সেটা দেখেই তার বিচার হয় কি না। তা ছাড়া আপনার কেসটাও গোলমেলে। বিজ্ঞান কেটে পদ্য করতে হবে। ধরা পড়লে দৈববাণীরই গদান যাবে, আপনার আর কী?”
ভুবনবাবু একটু বিরস মুখে বললেন, “পনেরো পর্যন্ত যেতে পারি। তার বেশি পেরে উঠছি না।”
“পনেরো!”
“পনেরো দিয়েই চালিয়ে দাও ভায়া। নোবেল পেলে বাদবাকি শোধ করে দেব।”
“খুব ঝামেলায় ফেললেন মশাই। তা আপনি ভগবানেরও পেয়ারের লোক, আপনার কথাটা আর ফেলি কী করে? তবে ওই পনেরো হাজারই টেবিলের ওপর রেখে একটু আড়ালে যান।”
“বাঁচালে!” ভুবনবাবু তাড়াতাড়ি আলমারি খুলে টাকা বের করে যথাস্থানে রেখে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন।
দুলালবাবু টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে অন্ধকারে পাঁচুসমেত হাওয়া হলেন।
পাঁচুর মেজাজটা ভাল যাচ্ছে না। বলল, “টাকা তো দু’হাতে লুটছেন, কিন্তু আপনার কপালে লক্ষ্মী বড় অস্থির। ভাল করে বসতে পারছেন না।”
“তোমার বড় লোভ পাঁচু। ওইজন্যই তোমার উন্নতি হচ্ছে না।”
“আজ্ঞে তা যা বলেছেন। তবে কিনা গরিবের কথা বাসী হলে মিষ্টি হয়। এই যে টাকাকে টাকা মনে করছেন না, দু-পাঁচ হাজার টাকা ফেলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এতে মা লক্ষ্মী চটে যান। পরে দেখবেন হা-টাকা হো-টাকা করে মরতে হবে।”
“আহা, হবে হবে। টাকাও হবে, নামও হবে, ফুর্তিও হবে। শুধু টাকায় কোনও মজা নেই।”
“আজ রাতের মতো ক্ষ্যামা দিন কর্তা। দুটো চোখের পাতা এক হল না আজ। আমি বুড়োমানুষ, আপনার মতো তেজী লোকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পেরে উঠছিনে।”
“তাও হবে। বিশ্রাম তো সকলেরই দরকার। তবে গা আর একটু ঘামিয়ে তবে বিশ্রাম করলে আরাম পাবে। পনেরো হাজার টাকারও একটু ব্যবস্থা করা দরকার।”
পাঁচু আঁতকে উঠে বলে, “ব্যবস্থা! সে আবার কী? টাকাটা আমাদের আজ রাতের শেষ রোজগার। ওটা আর জলে ফেলবেন না।”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না না জলে ফেলব কেন? কোথায় ফেলব সেটাই ভাবছি।”
সকালবেলা ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই ভুবনবাবুর মনে একটা শব্দ যেন ডুগডুগি বাজাতে লাগল, “কবিতা! কবিতা! কবিতা!” ভুবনবাবু সটান উঠে বসলেন। অনুভব করলেন তাঁর মাথা থেকে কে যেন রাতভর ঝেটিয়ে বিজ্ঞানের আবর্জনা সব বিদেয় করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের আর তলানিও তাঁর মাথার মধ্যে পড়ে নেই।
ভুবনবাবু হাসি হাসি মুখ করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। তারপর জানলা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগলেন। সূর্য উঠি-উঠি করছে। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। বেশ কুয়াশা হয়েছে আজ। টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। ভুবনবাবুর মনে হল, পৃথিবীটা যেন কবিতায় কবিতায় ছয়লাপ হয়ে আছে। আকাশে যেন অজস্র কবিতা ঘুড়ির মতো উড়ে-উড়ে লাট খাচ্ছে।
কবিতা যেন গাছে-গাছে বানরের মতো ঝুল খাচ্ছে। পাখিদের গলা থেকেও যেন কবিতারই কিচিরমিচির বেরিয়ে আসছে। তিনি শিশিরের শব্দের মধ্যও কবিতার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন। কে যেন লিখেছিলেন, “কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি!” না, ভুবনবাবুর মন আজ উলটো কথাই বলতে চাইছে, “কবিতা, আমার মুঠিতে তোমার ঝুঁটি।” কিংবা ঝুঁটির বদলে টুটিও চলতে পারে। কবিতাকে ছুটি দেবেন কি, কবিতা থেকে কি কারও ছুটি আছে?
ভুবনবাবু হাত-মুখ ধুয়েটুয়ে তৈরি হয়ে রামলালকে ডেকে পাঠালেন। রামলাল কাঁচুমাচু মুখে এসে দাঁড়ালেন, “আজ্ঞে, আমাকে ডেকেছেন?”