পাঁচু ড্যাবড্যাব করে ভুবনবাবুর দিকে চেয়েছিল। বলল, “বাপের জন্মে এমন কাণ্ড দেখিনি। আমার ব্যাপারটা তেমন সুবিধের ঠেকছে না।”
“দুলালবাবু র্যাপারে মুখটা ভাল করে ঢেকে নিয়ে একটু অন্ধকারের দিকে সরে গিয়ে হঠাৎ হাঁক মারলেন, “ভুবনবাবু, শুনতে পাচ্ছেন?”
দুলালবাবুর বজ্রকণ্ঠ; শুনে সবাই চুপ মেরে গেল। ভুবনবাবু একটু চমকে উঠে বললেন, “এ যে দৈববাণীর গলা মনে হচ্ছে!”
“আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন। দেখলেন তো, কেমন উড়লেন!”.
ভুবনবাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “তা খুব দেখছি বাপ দৈববাণী! আর দেখতে ইচ্ছে নেই। তা এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের পথ বাতলাতে পারো?”
“খুব পারি। আপনাকে যে বারণ করলুম রাতবিরেতে ওড়বার দরকার নেই, তা কথাটা তো শুনলেন না। তার ওপর চার হাজার টাকা বকেয়া পড়ে আছে, সেটা উশুল না হলে যন্ত্রটাই বা নামে কী করে? যার-তার কাছে তো আর বাকি পড়ে নেই, স্বয়ং ভগবানের কাছে বাকিবকেয়া রাখাটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“ঘাট হয়েছে দৈববাণী, মাটিতে পা রাখতে দাও, তক্ষুণি টাকাটা ফেলে দেব।”
“আজ্ঞে কথাটা মনে রাখবেন।”
“হাড়ে হাড়ে মনে রাখব। কিন্তু নামাবে কী করে?”
“ঢিল ছুঁড়ে।”
“ও বাবা! বলো কী?”
‘ভয় পাবেন না, ঢিল বেঁধে দড়ির একটা প্রান্ত ছুঁড়ে দেব, আপনি টপ করে ধরে কোমরে দড়িটা ধরে বেঁধে ফেলবেন। আমরা সবাই মিলে দড়ি ধরে টেনে নামিয়ে আনব।”
ভুতো তার ঘরে এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল। চেঁচামেচি শুনে হঠাৎ বেরিয়ে এসে কাণ্ডটা দেখে অবাক হল। ভুবনবাবু যে কেন এবং কীভাবে আকাশে ঝুলছেন তা একমাত্র সেই জানে।
সে একটু রাগের সঙ্গেই চেঁচিয়ে বলল, “জনার্দনদা, দাদুকে নামিয়ে দাও বলছি, নইলে লম্বোদরকে বলে দেব।”
একথায় ভয় খেয়ে জনার্দন ফুটদশেক নেমে এসে একটু উঁচু থেকে আলগোছে ভুবন রায়কে ছেড়ে দিল।
ভুবন রায় মাটিতে পড়েই চেঁচিয়ে উঠলেন, “বাবা রে!”
না, বেশি চোটটোট লাগেনি। হাঁটুটা একটু ঝিনঝিন করল আর মাথাটা একটু টাল খেল। তবু ভুবনবাবু রামলালকে বললেন, “দ্যাখো দ্যাখো, হাড়টাড় ভাঙল টাঙল কি না।”
রামলাল দেখেটেখে বললেন, “আজ্ঞে না, সব ঠিক আছে।”
বহু অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে এল ভুবন রায়ের দিকে। অনেক টেপরেকর্ডার। ভুরন রায় সূক্ষেপও করলেন না। বললেন, “আমার আর এসব দিকে মন নেই। আগে একটু ঠাণ্ডা হই। তারপর দেখা যাবে।”
হাতের যন্ত্রটা রামলালের দিকে এগিয়ে দিয়ে ভুবন রায় বললেন, “এটা এক্ষুনি নষ্ট করে ফ্যাল। এসব জিনিস অত্যন্ত বিপজ্জনক। হামানদিস্তায় ফেলে গুড়ো করো, তারপর অ্যাসিড ঢালো, তারপর পেট্রল ঢেলে আগুন দাও, তারপর মাটি সাত হাত গর্ত করে পুঁতে ফ্যালো। তার আগে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব না।”
রামলাল যন্ত্রটা নিয়ে বললেন, “যে আজ্ঞে। তবে এমন একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার এভাবে নষ্ট করলে যদি লোকে আপনাকে খারাপ ভাবে?”
ভুবন রায় মাথা নেড়ে বললেন, “যে যাই ভাবুক, ও-জিনিস নষ্ট না করলে আমি রাতে ঘুমোত পারব না।”
ভুবন রায় তাঁর ঘরে এসে যখন ঘরের পোশাক পরে বাথরুমে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন তখন জানলা দিয়ে একটা গলা খাঁকারির শব্দ এল, “আজ্ঞে দৈববাণী বলছিলুম।”
ভুবন রায় বিরক্ত হয়ে বললেন, “ও, তোমার সেই টাকাটা বুঝি?”
“যে আজ্ঞে। টাকাটা জানলার কাছে টেবিলের ওপর রাখলেই হবে।”
ভুবনবাবু বাক্স খুলে টাকা বের করে চার হাজার গুনে টেবিলে রেখে বললেন, “শোনো বাপু, ভগবানকে গিয়ে বোলো আর নোবেলের দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে।”
“যে আজ্ঞে। তবে কিনা নোবেল আপনার বাঁধা। বিজ্ঞানে হল না তো কী! পদ্যে হবে।”
“হবে!” ভুবনবাবু ভারি অবাক হলেন।
“পদ্যেই হবে। লিখে দেখুন।”
ভুবনবাবুর আর বাথরুমে যাওয়া হল না। জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর জানালার দিকে চেয়ে ভারি খুশিয়াল গলায় বললেন, “কী করে বুঝলে যে পদ্য আমার হাতে হবে?”
“ও বুঝতে দেরি হয় না মশাই। যার ভিতরে ভগবান এলেম দিয়েছেন তিনি যাতে হাত দেবেন তাতেই সোনা ফলবে। পদ্য লিখতে চান তাও হবে, যাত্রার পালা লিখতে চান তাতেও নোবেল এসে যাবে, চিন্তাশক্তির জন্য কোমর বেঁধে যদি লেগে পড়েন তাতেও নোবেল থেকে রেহাই পাবেন না। তা টাকাটা তোলা আছে তো মশাই?”
“আছে। কিন্তু মুশকিল হল কী জানো হে দৈববাণী, আমি জীবনে পদ্যটদ্য বড় একটা লিখিনি।”
“তাতে কী? আপনার ভেতরে কী আছে তা কি ছাই আপনি জানেন? কলম ধরলেই দেখবেন হুড়হুড় করে সব বেরিয়ে পড়বে। এই যে আপনি বিজ্ঞানের ‘ব’ ও জানতেন না, তবু দেখলেন তো কেমন চট করে ওড়বার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন!”
ভুবনবাবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “না না, আর এই সব্বোনেশে যন্ত্রটার কথা মুখেও এনো না হে দৈববাণী। যন্ত্রটার কথা আমি বেবাক ভুলে যেতে চাই। তুমিও ভুলে যাও।”
“তা না হয় চেষ্টা করব মশাই, কিন্তু ভোলাও কি সহজ কাজ, ভগবান আপনার মধ্যে বিজ্ঞানটা যে বড্ড বেশি করে দিয়েছেন, তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানটা আপনি চালিয়ে যান।”
ভুবনবাবু আবার মাথা নেড়ে আতঙ্কিত গলায় বললেন, “না না, কক্ষনো না, বিজ্ঞানে আমার সাঙ্ঘাতিক অরুচি এসে গেছে। ওর ধারে কাছেও আমি আর মাড়াচ্ছি না।”
“ভগবান কি ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখবেন? আপনার ক্ষমতাতে তো আপনি আলু দিয়ে অ্যাটম বোমা, মোচা দিয়ে রকেট, চাই এক নস্যির ডিবে দিয়ে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন বানিয়ে ফেলতে পারেন। এতখানি প্রতিভা নষ্ট করবেন মশাই? ভগবান যে ভারি দুঃখ পাবেন।”