এদিকে তাঁর পরিবারের লোকজন, ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি, সব বাক্যহারা হয়ে গোল গোল চোখ করে চেয়ে আছে। এ যে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! দেখতে-দেখতে ভুবনবাবু দশ হাত, বিশ হাত ওপরে উঠে গেলেন। এবং তারপরও উঠতেই লাগলেন। অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে ভুবনবাবুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছিল।
ভুবনবাবু ওপর থেকে রামলালের উদ্দেশে বিকট হাঁক মেরে বললেন, “ওহে, অমন উজবুকের মতো চেয়ে দেখছ কী? শিগগির আমাকে নামানোর ব্যবস্থা করো। এই বুড়ো বয়সে পড়ে গেলে যে মাজা ভাঙবে, সে মাজা আর জোড়া লাগবে না।”
রামলাল বললেন, “যে আজ্ঞে। তবে কীভাবে নামানো যায় সেটাই ভাবছি। আপনার যন্ত্র তো খুবই সাকসেসফুল দেখতে পাচ্ছি। তা ওটায় নামবার গ্যাজেট নেই?”
ভুবনবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “যন্ত্রে কী আছে না আছে তা কি ছাই আমিই জানি? তুমি বরং একখানা মই জোগাড় করে নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি করে, আমার বড্ড ভয় করছে।”
শুধু রামলাল নন, ভুবনবাবুর বিপদ দেখে সকলেই মইয়ের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিল। বাঁশের একটা মই বাড়ির নানা কাজে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। সেইটে যখন নিয়ে এসে দাঁড় করানো হল, তখন ভুবনবাবু মই-এর নাগালের অনেকটা ওপরে ঝুলে আছেন। মই বেয়ে নামা অসম্ভব।
ভুবনবাবু পেঁচিয়ে উঠে বললেন, “আর লম্বা মই পেলে না? কেন যে তোমরা ছোট-ছোট মই তৈরি করো তাও বুঝি না। লম্বা লম্বা মই না বানালে মানুষের উন্নতিই বা হবে কী করে? ওহে নন্দলাল, যাও না একটু দমকলে খবর দাও। ওদের কাছে ওম্বা মই থাকে বলে শুনেছি।”
“যে আজ্ঞে!” বলে নন্দলাল ছুটলেন।
কিন্তু ভুবনবাবু ধীরে ধীরে এত ওপরে উঠে যাচ্ছিলেন যে, দুনিয়ার কোনও মই তাঁর নাগাল পাবে বলে মনে হচ্ছিল না। শ্যামলাল টর্চ জ্বেলে দিলেন। কিন্তু টর্চের আলোও আর ভুবনবাবুর কাছে পৌঁছচ্ছিল না।
ভুবনবাবু ওপর থেকে খুব চেঁচামেচি করতে লাগলেন, “এই নাক মলছি, কান মলছি, আর এরকম বিদঘুঁটে আবিষ্কার করব না। আমি বিজ্ঞান একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছি। রামমাঃ, কোন পাগলে বিজ্ঞান জিনিসটা আবিষ্কার করেছে কে জানে বাবা। এর মতো খারাপ জিনিস হয় না। ও হে রামলাল, তোমারও আর বিজ্ঞানচর্চা করার দরকার নেই। কাল থেকে তুমি বরং সংস্কৃত শিখতে লেগে যাও। ল্যাবরেটরিটা তুলে দিয়ে শিব মন্দির করে ফেলব এবার। ওহে রামলাল, শিবমন্দির করাটাই কি ভাল হবে? নাকি কালী প্রতিষ্ঠা করবে? নাঃ এখানে দেখছি বড্ড ঠাণ্ডা….”
ভুবনবাবু বারকয়েক হাঁচলেন।
এদিকে ভুবনবাবুর গগনবিহারের খবর পেয়ে পাড়া-প্রতিবেশী এসে জড়ো হতে লাগল। তারপর শহর ভেঙে পড়ল। হ্যাঁজাক, টর্চ, গাড়ির হেডলাইট ইত্যাদি জ্বেলে ভুবনবাবুর উড্ডীন অবস্থা সবাই দেখার চেষ্টা করতে লাগল।
বনবিহারীবাবুর বয়স নব্বইয়ের কোঠায়। তিনি আকাশের দিকে চেয়ে গদগদ স্বরে বললেন, “আহা, ভুবনবাবু সশরীরে স্বর্গে যাচ্ছেন। এমন কপাল কি আর আমাদের হবে! কত বড় পুণ্যাত্মা ছিলেন। আহা!”
শহরের সবচেয়ে বোকা হলেন হরিপদ রায়। তিনি অনেকক্ষণ ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করে বললেন, “পেটে খুব গ্যাস হয়েছিল নিশ্চয়ই।”
করালীর মা বরণকুলো নিয়ে এসে বসেবসে চোখের জল ফেলছিলেন, আর তাঁর তিন নাতনি তিনটে শাঁখে ক্রমান্বয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল। কালীর মা বলছিলেন, “আমার অনেকদিন থেকেই মনে হচ্ছিল আমাদের ভুবনখুড়োই কল্কি অবতার। মুখে কখনও কথাটা উচ্চারণ করিনি বটে, পাছে পাঁচকান হয়, এখন দেখলে তো, কল্কি অবতার আসলে কে।”
জনার্দন ভুবনবাবুকে অনেকটা উঁচুতে তুলে ফেলেছিল। কিন্তু বুঝতে পারল, এতে মজাটা মাটি হচ্ছে। তা ছাড়া ভুবনবাবু ভয় খেয়ে কেমন যে গোঁ গোঁ করতে লেগেছেন। সুতরাং জনার্দন ঝড়াক করে ত্রিশ-চল্লিশ ফুট নীচে নামিয়ে এনে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল।
ভুবনবাবুকে টর্চের ফোকাসের মধ্যে পেয়ে সবাই খুব চেঁচাতে লাগল।
“এই যে ভুবনবাবু, নমস্কার…” “অভিনন্দন ভুবনবাবু…” “ও ভুবনদাদু, আমাকে একটু ওড়াবে?…” “পেন্নাম হই ভুবনকর্তা, এ যা দেখালেন একেবারে জম্পেশ ব্যাপার, একটু শিখিয়ে দিতে হবে কতা, দুটো পয়সা আসবে তা হলে গরিবের ঘরে….” “আচ্ছা ভুবনদাদু, ওখানে খাবার পাওয়া যায়…..” “ভুবনদাদু কি পাখি হয়ে গেল বাবা?”
ভুবনবাবু একটু নীচে নেমেছেন বলে ধাতস্থও হয়েছেন। ওপর থেকে হাঁক মারলেন, “রামলাল, নন্দলাল, শ্যামলাল, তোমরা করছটা কী? পাঁচজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তোমরাও মজা দেখছ? যাদের বাপের এত বড় বিপদ তারা দাঁড়িয়ে কী করে মজা দেখতে পারে তা তো আমার মাথায় আসে না।
রামলাল ব্যথাহত গলায় বললেন, “বাবা, আপনি কী বলছেন! আমি তো আপনার এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি। বাস্তবিকই আপনার চার-পাঁচবার নোবেল পাওয়া উচিত।”
ভুবনবাবু অত্যন্ত তিক্ত গলায় বললেন, “নোবেল! বিজ্ঞানে নোবেল! ও আমি ছোঁবও না। এ-যাত্রা যদি বেঁচে যাই তাহলে আমি পদ্য লিখতে শুরু করব। রবি ঠাকুরের মতো পদ্য লিখেই নোবেল পাব। বিজ্ঞান-টিজ্ঞান আর নয়।”
ভিড়ের মধ্যে আরও দুটি লোক গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখছিল। একজন দুলাল সেন, অন্যজন পাঁচু মোদক।
দুলালবাবু চাপা গলায় বললেন, “ও পাঁচু, লোকটা যে আমাদের বোকা বানিয়ে দিল. হে! সত্যিই কি ওটা ওড়ার যন্ত্র নাকি!”