এই বলে বিস্মিত পাঁচু মোদকের চোখের সামনেই টাকার তাড়াটা ফের ল্যাবরেটরির মধ্যে জানলা গলিয়ে ছুঁড়ে দিলেন দুলালবাবু। পাঁচু হাঁ-হাঁ করে উঠেছিল, দুলালবাবু তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বললেন, “মজাটার কথা ভাবো। মজাই যদি না পেলে তা হলে টাকা কোন ভুতের বাপের শ্রাদ্ধে লাগাবে?”
“পাঁচশো টাকায় যে গন্ধমাদন হয়ে যেত মশাই।”
“গন্ধমাদন তো কিছুই নয়। টাকার বান ডাকিয়ে দেব। চলো।” পাঁচু গোপনে চোখের কোলটা মুছে নিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে।”
জনার্দন উড়ান-যন্ত্রে মধ্যে ঢুকে বেশ একটু ঘুমিয়ে নিল। তবে ভুতের ঘুম মানুষের ঘুমের মতো তো নয়। চারদিকে যা-যা ঘটছে, তা সব তার মগজে একেবারে ভিডিও রেকর্ডিং-এর মতো উঠে যেতে লাগল। গাড়ল ভুবনবাবু চেঁচিয়ে লোক জড়ো করছেন, সেই ফাঁকে জাঁহাবাজ দুলাল সেন আর ফচকে পাঁচু হাওয়া হল। সে ফস করে বাক্স থেকে বেরিয়ে দুলালবাবু আর পাঁচু মোদকের গতিবিধিও লক্ষ করে নিল। খুব নিশ্চিন্তে, দুলকিচালে দু’জনে অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে পোড় বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। ভূতের সমাজ এদের ভয়েই আজকাল সিঁটিয়ে আছে। এরা ভুত ধরার ব্যবসা করতে চায়। যা এলেম দু’জনের দেখা গেল, তাতে কাজটা
অসম্ভব বলেও মনে হল না জনার্দনের।
জনার্দন ফের ফিরে এসে যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
জাঁহাবাজ দুলাল আর ফচকে পাঁচু যদিও লোকটাকে বোকা বানানোর তাল করছে, কিন্তু এই সুযোগে ওদেরই বোকা বানানো যাক। ভুবনবাবুকে সে উড়িয়ে আসবে।
ওদিকে ভুবনবাবুর চেঁচামেচিতে রামলাল, নন্দলাল, শ্যামলাল সবাই ছুটে এসেছেন। তাঁর নাতি-নাতনিরাও এসে গেছে।
ভুবনবাবু বিশ্বজয়ীর হাসি হেসে বললেন, “ইউরেকা!”
রামলাল এগিয়ে এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বানালেন নাকি?”
“বানালুম মানে! পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বললে কম বলা হয়। ওদিকে শুনলুম, নিউটন আর আইনস্টাইনেরও টনক নড়ে গেছে। স্বয়ং ভগবান অবশ্য খুব খুশি।”
কেউ ব্যাপারটা ধরতে না পেরে পরস্পর মুখ-তাকাতাকি করছিল।
ভুবনবাবু সহাস্যে বললেন, “কাজটা যে-ই শেষ করেছি অমনি দৈববাণী।”
রামলাল প্রতিধ্বনি করলেন, “দৈববাণী? বলেন কী?”
“আর বলো কেন, একেবারে খাঁটি দৈববাণী। বললে, একবার নয়, চার পাঁচবার নাকি আমি নোবেল পাব।”
রামলাল মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক আছে। আপনি বরং খেয়েদেয়ে একটু ঘুমোন, অনেক খাটুনি গেছে তো।”
ভুবন রায় ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এত বড় একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেললুম, অথচ সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তুমি আমার খাওয়া আর ঘুম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন বলো তো!”
রামলাল সভয়ে বললেন, “আজ্ঞে, বলছিলুম, খুব ধকল গেছে তো।”
ভুবন রায় হিমশীতল গলায় বললেন, “তার মানে তোমার ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না! এই তো?”
রামলাল জিব কেটে বললেন, “কী যে বলেন! আপনার আরও সব অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের কথা কে না জানে!”
“দৈববাণীর কথাটাও তোমার বিশ্বাস হয়নি মনে হচ্ছে।”
রামলাল সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “দৈববাণীকে বিশ্বাস না করার কিছুই নেই। দৈববাণী হতেই পারে। হয়ও।”
“তুমি শুনেছ কখনও?”
“আজ্ঞে না। তবে কি আমি যুগান্তকারী কোনও আবিষ্কারও তো করিনি!”
ভুবন রায় চারদিকে তাকিয়ে সকলের মুখ দেখলেন। মুখে যা দেখলেন তাতে খুশি হলেন না। তাঁর মনে হল, এরা কেউ তাঁর কথায় ঠিকমতো বিশ্বাস করতে পারছে না। খুঁতখুঁত করছে।
ভুবন রায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বড় বড় বিজ্ঞানীদের অনেক মেহনত করে লোককে বিজ্ঞান বিশ্বাস করাতে হয়েছিল। আমার কপালেও সেই কষ্টই আছে। বহোত আচ্ছা, বাদুড়ের নখ, প্যাঁচার অ্যাটাক সব উপেক্ষা করে এই রাতেই আমি আকাশে উড়ে তোমাদের দেখাচ্ছি।”
এই বলে কেউ বাধা দেওয়ার আগেই ভুবন রায় দৌড়ে তাঁর ল্যাবরেটরিতে ঢুকে হাতে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো যন্ত্রটা নিয়ে ফের দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখবে? তা হলে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার জন্য প্রস্তুত হও। চার-পাঁচটা নোবেল আমার কেন পাওয়া উচিত তা তোমাদের নিরেট মাথায় এবার ঢুকবে।”
যন্ত্রটা নিয়ে কী একটু কারিকুরি করলেন ভুবনবাবু কে জানে। সবাই সভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বাস্তবিকই সকলের চোখ গোল-গোল হয়ে উঠতে লাগল।
যন্ত্রটার মধ্যে খুব একটা কারিকুরি করার মতো কিছু ছিল না। ভুবনবাবু খানিকটা পারদ, খানিকটা হাইড্রোজেন গ্যাস, খানিকটা আরও সব আগড়ম বাগড়ম মিশিয়ে যা-খুশি একটা কিছু করে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনেছেন বিজ্ঞানের বেশিরভাগ আবিষ্কারই হয়েছে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে। এরকম কোনও অঘটন ঘটাতেই তাঁর চেষ্টা ছিল। দৈববাণীর ভরসা পেয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, তাঁর অঘটনঘটনপটিয়ান মাথা সত্যিকারের উড়ানযন্ত্র তৈরি করে ফেলেছে।
কিন্তু কী করে যন্ত্রটা ক্রিয়াশীল করতে হবে তা তাঁর জানা ছিল না। তিনি যন্ত্রটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে না করতেই জনার্দন যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে ভুবনবাবুকে সাপটে ধরে আকাশে উঠে যেতে লাগল। বেশ ধীরে ধীরে দুলকি চালেই সে উঠছিল। কিন্তু ভুবনবাবু ঘাবড়ে গিয়ে “বাবা গো, মা গো” বলে চেঁচিয়ে হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন। উত্তেজনার মাথায় রামলালকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি উড়তে চেয়েছিলেন বটে কিন্তু যে-ই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল অমনি তাঁর সাহসের বেলুন গেল চুপসে।