একেবারে নিজের ঘরটিতে পৌঁছে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগলেন। খানিকক্ষণ জিরোবার পর হঠাৎ খেয়াল হল, হেলমেটটা তিনি ভৌত ক্লাবের ঘরেই ফেলে এসেছেন।
২. ভুবন রায়ের বয়স পঁচাশি
ভুবন রায়ের বয়স পঁচাশি বটে, কিন্তু তাঁকে বুড়োমানুষ বললে অপমানই করা হবে। ভুবন রায় ওলিম্পিকে দেশের হয়ে ওয়েটলিফটিং করে এসেছেন যৌবন কালে। একটা মেডেল পেলেও পেয়ে যেতে পারতেন। পারলেন না কেবল খাওয়ার প্রতি তাঁর সাঙ্ঘাতিক লোভের জন্য। প্রতিযোগিতার দিন সকালবেলায় তিনি একরাশ মাংস আর ডিম খেয়ে অ্যায়সা ওজন বাড়িয়ে ফেলেছিলেন যে, তাঁকে লাইট-হেভি গ্রুপের প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হল না। কর্মকর্তারা বললেন, “তোমাকে হেভিওয়েটে কমপিট করতে হবে।” তবে ভুবন রায় দমবার পাত্র নন। কোমর বেঁধে হেভিওয়েট গ্রুপের দৈত্য-দানবদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি ষষ্ঠ স্থান দখল করেছিলেন। লাইট-হেভি গ্রুপে হলে যে সোনার মেডেল জয় করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন হত না, এ কথা সবাই স্বীকার করেছিল। তা ভুবন রায়ের জীবনটাই এমনি। মিলিটারিতে বেশ উঁচু পর্যায়ের অফিসার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভালরকম লড়াই করেছেন। কিন্তু যুদ্ধ যেই থামল, অমনি তাঁর জীবনটা আলুনি হয়ে গেল। মিলিটারিতে চাকরি করবেন, অথচ যুদ্ধ করবেন না, এটা তাঁর কাছে এক অসহ্য ব্যাপার। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেবেন, এটা তাঁর অনেক দিনের সাধ। কিন্তু যুদ্ধ থামবার পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল এবং সবাই শান্তির বাণী কপচাতে লাগল দেখে তিনি ভারি চটে গেলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন, “ভারতবাসীরা যুদ্ধ করেনি বলেই মানুষ হয়ে উঠতে পারছে না। যুদ্ধ বাধালে দেশের যুবশক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে, জাতীয় চরিত্র গঠিত হবে না। যুদ্ধই জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করে। অতএব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি একটা যুদ্ধ ঘোষণা করুন।” বলাই বাহুল্য, এ চিঠির প্রতি প্রধানমন্ত্রী তেমন গুরুত্ব দেননি, তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠিটা পাঠিয়ে দেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে ওই চিঠি লেখার দরুন ভুবন রায়ের কোর্ট মাশাল হওয়ার জোগাড়। ভুবন রায় তাতেই কী খুশি। কোর্ট মার্শাল হয়ে যদি গুলি খেয়ে মরতে হয়, তা হলেও একরকম দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার শামিল হবে ব্যাপারটা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা হল না। নতুন সরকার দয়ার অবতার, শান্তির বাণী ছাড়া মুখে কথা নেই। তাই তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হল। ভুবন রায় ঘেন্নায় নাক সিঁটকে মিলিটারির চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর এই গঞ্জে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে দুধের ব্যবসা শুরু করলেন। মেলা গোরু কিনে ফেললেন এবং দুধ, মাখন, ঘি তৈরি করে বাড়ি বাড়ি ফিরি করে বেড়াতে লাগলেন। খাঁটি ঘি-দুধের অভাবেই যে বাঙালির স্বাস্থ্যের এত অবনতি, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু গঞ্জের মানুষের তেমন পয়সা নেই। সবাই ধারবাকিতে ঘি দুধ- কেনে, কিন্তু পরে আর ধার শোধ করতে পারে না। ভুবন রায়ের ব্যবসা লাটে উঠল। এরপর তিনি জুতোর দোকান খুললেন। তাতেও বিশেষ সুবিধে হল না। অবশেষে চাষবাস শুরু করার পর তাঁর কপাল খুলে গেল।
ভুবন রায়কে ভয় পায় না, এমন লোক গোটা পরগনায় নেই। ছেলেরা কেউ তাঁর চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। শুধু তাই নয়, এখনও প্রত্যেকদিন রাত্রিবেলা তিনি তাঁর চার ছেলেকে ডেকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রায়ই বকাঝকা করেন। বড় ছেলেন বয়স পঞ্চাশের ওপর। সবচেয়ে ছোটটির বয়স পঁচিশ। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু ভুবন রায় তাঁদের নাবালক ছাড়া কিছুই মনে করেন না।
ইদানীং ভুবন রায়ের মাথায় বিজ্ঞান ভর করেছে। একদিন ছাদে বেড়াতে বেড়াতে তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন, গোটা দুনিয়াটাই জ্যামিতিতে ভরা। ছাদটা একটা আয়তক্ষেত্র, চাঁদটা একটা বৃত্ত, সুপুরি গাছগুলো সরলরেখা এবং চারদিকে আর যা-যা আছে, সব কিছুই জটিল জ্যামিতিক নকশা ছাড়া আর কিছুই নয়। জ্যামিতি ও ঘন জ্যামিতি।
আর একদিন তিনি দুধ, কলা আর খই মেখে ফলার খেতে গিয়ে হঠাৎ বোধ করলেন, এ তো রসায়ন। দুধ, কলা আর খই মেশানো এই যে পদার্থটি একে রাসায়নিক সংমিশ্রণ বলা যায় না কি? এই যে জল খাচ্ছেন, এও তো এইচ টু-ও! চারদিকেই ভুবন রায় তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখতে লাগলেন।
একদিন তাঁর নাতনি বাবলি ফিজিক্স পড়ছিল। পাশের ঘর থেকে ভুবন রায় আলোর প্রতিসরণের অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাই তো! পদার্থবিদ্যাই তো আসল বিদ্যা।
আবার আড়াই টাকা করে সের সাতাশ পো দুধের দাম কত, এটা একদিন গয়লাকে বোঝাতে গিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখন গয়লা অনায়াসে দামটা বলে দেওয়ায় ভুবন রায় নিজের অঙ্কবোধের অভাবে ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। তারপর থেকেই দুপুরবেলা নাতি-নাতনিদের অঙ্কের বই নিয়ে চুপিচুপি আঁক কষা শুরু করেন।
ভুবন রায়ের বড় ছেলে রামলাল কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। অতিশয় নিরীহ মানুষ। ভুবন রায় একদিন সন্ধেবেলা তাঁকে ডেকে পাঠালেন।
‘‘আজ্ঞে?”
“তুমি তো একজন বিজ্ঞানী, না কি?”
রামলাল মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে, বিজ্ঞানী বললে বাড়াবাড়ি হবে। তবে বিজ্ঞানের অধ্যাপক বটে।