উড়ান-যন্ত্রটা যে কোনও কর্মের নয় তা জনার্দন হাড়ে-হাড়ে জানে। তবে তার মাথাতেও দুষ্টবুদ্ধি কিছু কম খেলে না। সে সুড়ক করে দেশলাইয়ের বাক্সের মতো যন্ত্রটার মধ্যে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইল।
ওদিকে ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে ভুবন রায় বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুলাল সেন আর পাঁচু মোদক হাসতে হাসতে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
পাঁচু বলল, “দুলালবাবু, আমার ওস্তাদ কালী তপাদার বলতেন, ‘ওরে দুনিয়াময় চুরি অনেকেই করে, কিন্তু সত্যিকারের জাত-চোর ক’জন? ক’জন সত্যিকারের ওস্তাদ? ক’জন সত্যিকারের শিল্পী?’ তা বলতে নেই দুলালবাবু, কালী তপাদারের চেলা হয়ে আমরা এতকাল যা করে বেড়িয়েছি তা নিছক ধ্যাষ্টামো, আপনি হলেন জাত-শিল্পী, আহা, কী বুদ্ধি, কি সাহস, কী বুকের পাটা!”
দুলাল সেন বুকটা একটু চিতিয়ে বললেন, “তা বলতে পারো, তবে কিনা এ হল কলির সন্ধে, এখনই কী দেখছ! এরপর আরও কত হবে।”
পাঁচু একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আপনার সবই ভাল দুলালবাবু, কিন্তু দোষের মধ্যে ওই খইটা, আপনি অল্পে খুশি নন, কেবল আরও চান, আরও চান। একসঙ্গে অত চাইতে নেই, আমার ওস্তাদ কালী তপাদার বলতেন, ‘ওরে থামতে জানতে হয়। থামতে না জানলে অতি বড়রও পতন অনিবার্য।’ আপনি ওই থামাটাই শেখেননি।”
“আহা, চটো কেন পাঁচু? বাচ্চাদের যখন প্রথম দাঁত ওঠে তখন তারা সবকিছুই কামড়াতে চায়। আমারও সেই দশা। চুরি করতে নেমে এমন নেশায় পেয়ে বসেছে যে, আর থামতে ইচ্ছে করছে না। তবে ক্রমে ক্রমে ধাত আসবে। থামতেও শিখব, তা হলে এবার কী করা যায় বলো তো!”
“এখন আর নতুন কাজে হাত দেবেন না, রাত পুইয়ে এল, এবার একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। কাল রাতেও তো আবার কাজে নামতে হবে।”
“তা বটে, তবে ঘুমোতে আমার তেমন ইচ্ছে করছে না।”
“তা বললে হবে কেন? আপনার শরীরে এখন হাতির বল, কিন্তু আমি বুড়ো মানুষ, আমার অত সয় না।”
“তা হলে এক কাজ করো, ওইপাশে আমার পুরনো বিছানাটা আছে, সটান গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি একটু যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করি। ভুবনবাবু এই ল্যাবরেটরির জন্যই আমাকে আনিয়েছিলেন, মনে পড়ছে।”
“এখানে পোব কী? ধরে ফেলবে যে!”
“আমি আছি, চিন্তা নেই।”
“কাজটা বিপজ্জনক হবে মশাই।”
“আরে আমাদের বিপদে ফেলবে তেমন মানুষ জন্মায়নি, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও, আমি সব সামলাব।”
পাঁচু অগত্যা হাই তুলতে তুলতে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। দুলালবাবু ভুবন রায়ের বানানো উড়ান-যন্ত্রটা হাতে নিয়ে একটু হেসে আপনমনে বললেন, “এঃ, উড়ান-যন্তর বানিয়েছে! নোবেল পাবে।”
ভুবন রায় যখন আনন্দে উদ্বাহু হয়ে ‘ইউরেকা, ইউরেকা,’ বলে চেঁচাচ্ছেন তখন চেঁচানির চোটে লোকজন দৌড়ে আসছে। কালী তপাদারের চেলা পাঁচু বিপদের গন্ধ পাঁচ মাইল দূর থেকে পায়। সে লাফিয়ে উঠে দুলালবাবুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, “কর্তা, এবার পালান।”
“আহা, হলটা কী? এখন তো কলির সন্ধে।”
“বিপদ। যে বিপদের গন্ধ না পায় সে চোর হওয়ার যোগ্যই নয়।”
দু’জনে একটা জানলা গলে বাইরে এলেন। পাঁচু বলে, “এবারটা ক্ষ্যামা দিন দুলালকা, হরেনের দোকান থেকে লুঠ করা সব জিনিস তো ফেলেই চলে আসতে হল, শুধু যদি বেশি লোভ না করতেন তা হলেই সোনাদানায় মিলিয়ে আমরা একক্ষণে লাখ টাকার মালিক হতুম। এখন যদি আর বেশি লোভ করেন তা হলে এই পাঁচশোও যাবে।”
দুলাল সেন চাপা গলায় ধমক দিয়ে বললেন, “নজরটা একটু উঁচু করতে শেখো তো! পাঁচশোতে কেন খুশি হতে যাব! লোকটা তো পাঁচ হাজার কবুল করেছে!”
“পাঁচ হাজার নয়, সাড়ে চার হাজার। আপনিই তোদর কমিয়ে দিলেন।”
“ওই হল। আরও চার হাজার আদায় না করে ছাড়ছি না।”
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আপনি চার হাজার আশা করে বসে থাকুন তবে। কাল সকালে যখন যন্তর নিয়ে উড়তে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে তখন বুঝবেন।”
‘আহা, তখন আর কোনও ফন্দি বের করা যাবে মাথা থেকে! এখন আমার মাথায় যে কত ফন্দি-ফিকির খেলছে সে আর তোমাকে কী বলব! মাথা-ভর্তি শুধু নানারকম ফন্দি-ফিকির। কী করে যে মাথাটা এত খুলে গেল, কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এতদিনে মাথাটা বেশ কাজ করতে লেগেছে।”
পাঁচু আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আহা, আপনার মাথাটা যদি আর একটু কম কাজ করত তা হলে আজ রাতেই আমরা রাজা হয়ে যেতুম।”
“রাজা হতে আর কীই বা পরিশ্রম! রাজা তিন দিনে বানিয়ে দেব। রোসো, মজাটা আগে দেখি। তোমার দোষ কী জানো?”
পাঁচু মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বলে, “গুনে দেখিনি, তবে দোষ মেলাই থাকবার কথা। আমার মতো লোক তো দোষে-গুণেই মানুষ। তা দোষটা কী দেখলেন?”
দুলালবাবু বললেন, “তুমি কাজের মধ্যে কেবল লাভ খোঁজো মজাটা খোঁজো। এসব কাজে লাভ যেমন, মজাও তেমনই। বরং মজাটাই বেশি।”
“যে আজ্ঞে। তা এক কাজ করলে হয় না? এ কারবারে মজাটা আপনি নিন, টাকাটা আমি। একেবারে ন্যায্য ভাগাভাগি।”
দুলালবাবু একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, “সেটা ভাল দেখাবে না। মজা জিনিসটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। সব সময়ে টাকা-টাকা করলে মজাটা মাটি হয়। তোমাকে আমি মজা থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।”
পাঁচু আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যে আজ্ঞে।”
দুলালবাবু অত্যন্ত গম্ভীর মুখ করে বললেন, “এমনকী, এই পাঁচশো টাকাও আমি নিতে চাই না। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। এসব ছোটখাটো কাজ করতে আজকাল আমার ঘেন্না হয়।”