“আমি নিমিত্ত মাত্র। ভগবানেরই ভোগে লাগবে। স্বর্গেও এখন জিনিসের দাম বেশ চড়া।”
“আচ্ছা, পঞ্চাশটা টাকা কাল সকালে থোক পুরুতমশাইকে দেব’খন, পুজো দিয়ে দেবে।”
“কী যে বলেন, পুরুত দিয়ে পুজো করাবেন কোন দুঃখে! ওসব মারফতি কারবার আর কেন? টাকাটা ফেলে দিন, আমরা টুক করে নিয়ে স্বর্গে একেবারে ভগবানের শ্রীচরণে ফেলে দিয়ে আসব। তিনি খুশিও হবেন। তবে পঞ্চাশ নয়।”
“কত?
‘চার হাজার নশো নিরানব্বই। এক টাকা ছেড়ে দিচ্ছি।”
“ও আমি পারব না।”
“পুরো সাড়ে চার হাজারই দিন তবে। মেলা কমে গেল। জলের দরে নোবেল।”
ভুবন রায় পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা গুনে বললেন, “না হে, হচ্ছে না।”
“কত আছে?”
“পাঁচশো টাকার মতো।”
“এখন ওটাই আগাম দিন। বাকিটা কাল নেব।”
“কোথায় রাখব।”
“টেবিলে ওই উড়ানযন্ত্রের পাশে রেখে একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, মিনিটখানেক।” ভুবন রায় তাই করলেন। এক মিনিট বাদে ঘরে ঢুকে দেখলেন, টাকাটা নেই। যন্ত্রটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি বিকটস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’
.
ভুতোকে শূন্যে ঝুলিয়ে এনে তার ঘরের দরজায় ঝপাস করে ফেলে জনার্দন বলল, “এ যাত্রা খুব বেঁচে গেলি যাহোক।”
ভুতো চির্চি করে বলল, “জনার্দনদা, একটা কথা ছিল।”
“আবার কী কথা?”
“লয়োদর আমার একটা বংশপরিচয় দিচ্ছিল।”
“তার জন্যই তো বেঁচে গেলি।”
“কিন্তু আমার বংশপরিচয়টা এমন কী যে তোমরা খাতির করলে!”
“তা আমি জানি না, লম্বোদর জানে।”
“আমি কি লম্বোদরেরই বংশধর?”
“তাই তো মনে হল।”
“সেই লম্বোদর আর এই লম্বোদর কি এক?”
“ওসব বড় গোলমেলে কথা। মারপ্যাঁচের ব্যাপার। কিন্তু তোর অত খতেনে কাজ কী? গদানটা যে বাঁচাতে পেরেছিস সেই ঢের।”
“তা বটে। তবে আমি যদি লম্বোদরের বংশধর হয়ে থাকি তা হলে কিন্তু আমাকে তোমার একটু খাতিরটাতির করা উচিত।”
জনার্দন একটু বিপন্ন গলায় বলল, “আবার খাতির চাইছিস! কেন, খাতিরটা কম কী করা হল শুনি!”
“তুমি মোটেই আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করোনি। কেবল ধমকেধামকে কথা বলছ। কিছু জিজ্ঞেস করলে কাটা কাটা জবাব দিচ্ছ। তোমার ব্যবহার মোটেই ভাল লোকের মতো নয়।”
“তা না-ই বা হল। লম্বোদরের বংশধর হয়ে কি মাথাটা কিনে নিয়েছিস নাকি?”
“তা আমি জানি না, লম্বোদরের সঙ্গে তো আর আমার তেমন সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই। সে কেমন লোক তাও জানি না, তবে লম্বোদর যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে তা হলে বলে দেব যে, তুমি আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছ।”
“কখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলুম? মহা পাজি ছেলে তো।”
“করোনি! এই যে সাত হাত ওপর থেকে দমাস করে ফেলে দিলে, আমার কোমরে কীরকম লেগেছে জানো?”
“আহা, ওরকম একটু-আধটু লেগেই থাকে। দাঁড়া, মালিশ করে দিচ্ছি।” মালিশের দরকার নেই। তবে শোধ তুলতে আমিও ছাড়ব না। সাত বছরের মেছো জালে গাবের আঠা আর লোহার গুড়ো মাখিয়ে যখন ভূত ধরব, তখন দ্যাখাব মজা।”
“সর্বনাশ! তুই তখন বড় বললি যে, শুনতে পাসনি!”
“তা ওরকম একটু-আধটু বলতে হয়।”
“তুই মহা নচ্ছার দেখছি। তা ভাই; কী চাস বল তো?”
“যা চাই দেবে?”
‘ভূতের সাধ্যে যা কুলোয় দেব।কিন্তু আমরা যে সব পারি তা কিন্তু নয়। অনেক কিছুই আমরা পারি না।”
“আমাদের ল্যাবরেটরিতে কয়েকদিন আগে এবাড়ির একটা ছেলে কয়েকটা কেমিক্যাল মিশিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেই কেমিক্যালগুলো কী তা বের করতে পারবে?”
“ও বাবা, সে যে বিজ্ঞানের ব্যাপার?”
“বিজ্ঞান কি কিছুই জানো না?”
“না রে বাপু। বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের ঘোর শত্রুতা, সবাই বলে, বিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্ত হলে ভূতে মন্দা দেখা দেয়।”
“তা হলে উপায়টা কী! ফরমুলাটা যে আমাদের দরকার।”
“কিন্তু আমাদের যে বিজ্ঞানের ধারে কাছে যাওয়া বারণ। লম্বোদরের কড়া হুকুম আছে।”
“লম্বোদর কিছু জানতে পারবে না। দুলাল সেন ভারী নিরীহ মানুষ ছিলেন। কিন্তু ওই বিস্ফোরণের ধোঁয়া নাকে যাওয়ার পরই তিনি ভীষণ গুণ্ডা আর ডাকাত হয়ে উঠেছেন। যদি তাঁকে আবার আগেকার মতো মানুষ করতে হয় তা হলে আমাদের ফরমুলাটা জানা দরকার।”
“বটে! দুলাল সেন মানে সেই বজ্জাত লোকটা তো।”
“হ্যাঁ, যিনি ভূতের ব্যবসা করতে চাইছেন।”
“তা হলে তো ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।”
জনার্দন চোখের পলকে ল্যাবরেটরিতে এসে হাজির হয়ে গেল। হাজির হয়ে যা দেখল, না দেখলে তার প্রত্যয় হতনা। দেখল, ভুবন রায় একটা চেয়ারে বসেনানা কথা বলছেন আর দুটো লোক আলমারির পিছনে ঘাপটি মেরে থেকে সেইসব কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে। মেদ্দা কথাটা হল, ভুবন রায় একটা আকাশে ওড়ার যন্ত্র বের করেছেন বলে খুব তড়পাচ্ছেন, আর তোক দুটো দৈববাণী করে খুব সায় দিয়ে যাচ্ছে। লোক দুটোকে চিনতে মোটেই কষ্ট হল না জনার্দনের। একজন দুলাল সেন, অন্যজন পাঁচু মোদক। কথাবার্তা দুলাল সেনই চালাচ্ছেন। কায়দাটাও বেশ ভালই। ভুবন রায় মাথা-পাগলা লোক, তাঁকে টুপি পরানো শক্ত নয়।
জনার্দন রাগে দাঁত কিড়মিড় করার চেষ্টা করল। তবে দাঁত নেই বলে কিড়মিড়টা তেমন জমল না, দুলাল সেন আর পাঁচু মোদক যে মহা ধূর্ত লোক তাতে সন্দেহ নেই। এই দু’জনের জন্যই আজ দুনিয়ার যত ভূতের চোখে ঘুম নেই। খাওয়া অর্ধেক হয়ে গেছে। এরা যে যথেষ্ট এলেম রাখে তা জনার্দনও স্বচক্ষেই দেখল।