দুলালবাবু ভারি বিরক্ত হয়ে লোকটাকে আর-একটা রদ্দা কষিয়ে হাঁটুর নীচে চেপে ধরে রেখে বললেন, “একটা জরুরি কথা হচ্ছে, এর মধ্যে কি হুটোপাটি করতে হয় রে দুষ্টু ছেলে : তারপর হরেনভায়া, বলো।”
হরেন বড় বড় চোখে দৃশ্যটা দেখল। তারপর চোখ বুজে ফেলে বলল, পাহারাদারগুলোকে কালই বিদায় করে দেব।”
দুলালবাবু খুব উৎসাহের গলায় বললেন, “সে খুব ভাল কথা। এসব রোগা দুবলা জীব দিয়ে কি আর ডানপিটেদের কাজ হয়! ও, কাল থেকে আমি আর পাঁচু মিলেই তোমার দোকান পাহারা দেব’খন। মাথাপিছু মাসে হাজারখানেক করে টাকা দিও, তাতেই হবে। আমাদের খাই বেশি নয়, আর তোমার দিকটাও তো দেখতে হবে।”
হরেন এবার চোখ খুলল, “ওকে ছেড়ে দিন। আর বেশিক্ষণ ওভাবে চেপে রাখলে মরে যাবে। রদ্দা খেয়েই বেচারা অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
“তাই নাকি!” বলে ভারি লজ্জিত মুখ করে দুলালবাবু লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “আর দেরি কোরো না ভায়া। টাকাটা ফেলে দাও, আমি লাশটা ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়ি। সেই পশ্চিমের জঙ্গলে গিয়ে কোদাল-গাঁইতি নিয়ে গর্ত করতে হবে, লাশ পুঁততে হবে, অনেক ঝামেলা। তোমার মুখ চেয়েই কষ্টটা স্বীকার করছি।”
হরেন মুখোনা তোম্বা করে বলল, “কাকে পুঁতবেন? লোকটা তো মরেনি।”
দুলালবাবু অবাক হয়ে বললেন, “মরেনি মানে? আলবত মরেছে। ওর ঘাড় মরেছে। না মরে ওর উপায় আছে।”
হরেন মাথা নেড়ে বলে, “আমি বলছি মরেনি। একটু আগেই আমি ওকে মশা মারতে দেখেছি।”
দুলালবাবু খুব হেসেটেসে মাথা নেড়ে বললেন, “না রে ভাই, না। ও তোমার চোখের ভুল।”
“মোটেই ভুল নয়। ওর কনুইয়ের গুঁতোয় আমার দারোয়ান রাম সিং পর্যন্ত মুছা ভেঙে উঠে পড়েছে।”
দুলালবাবু নিতান্ত ভালমানুষের মতো মুখ করে বললেন, “ওরকম হয়, মরার পরও হাত-পা একটু-আধটু নড়ে।”
“তার মানে?”
“পাঁঠা বলি দ্যাখোনি? গলা কেটে ফেলার পরও পাঁঠাটা কেমন ছটপট করে পা টানা দেয়, ম্যা-ম্যা করে ডাকে!”
“মোটেই ম্যা-ম্যা করে ডাকে না।”
“আহা, না ডাকলেও ছটফট তো করে। এও তাই। লোকটার মাথা ফুটো করে গুলি বেরিয়ে গেল, স্বচক্ষে দেখলাম। গুলির সঙ্গে ওর প্রাণটা লেগে ছিল। প্রাণটা নিয়েই গুলিটা বেরিয়ে গেল কিনা। একেবারে টা-টা গুডবাই করে চলে গেল।”
‘আপনারা দুজনেই জোচ্চার। ওই দেখুন, লোকটার চোখ মিটমিট করছে। ওই যে, কোমরের নীচে হাত দিয়ে চুলকোচ্ছে।”
“বটে! এত বড় সাহস!” বলে দুলালবাবু এক লাফে গিয়ে পাঁচুর ঘাড়টা চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করালেন। তারপর বললেন “বলি দু’দণ্ড চুপ করে মটকা মেরে শুয়ে থাকতে পারো না, আর এই বিদ্যে নিয়ে বড়াই করে বেড়াও! ছিঃ ছিঃ!”
পাঁচু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “বড্ড মশা যে!”
‘মশা! সামান্য মশার কামড়েই এই দশা! পায়ে কামড়েছে! দিলে তো দাঁওটার বারোটা বাজিয়ে। লোক্টাকে ভজিয়ে-ভজিয়ে যখন কাজটা প্রায় সেরে এনেছি তখনই উনি মশা মারতে লাগলেন।”
পাঁচুআমতা-আমতা করে বলল, “সব কাজেই যে কেন আপনার এত তাড়াহুড়ো তা বুঝি না। বুদ্ধিটাও বড্ড গোলমেলে। হরেন যখন অস্ত্র ফেলে কাঁদতে বসেছিল তখনই তো ওকে একটা রদ্দা মেরে টাকাটা কেড়ে নিতে পারতেন। তা না করে আপনি আমাকে মড়া সাজাতে গেলেন। এই বুদ্ধি নিয়ে কি কাজ হয়?”
“তাও তো বটে!” বলে দুলালবাবু হরেনের দিকে তাকালেন। কিন্তু হরেন এখন অস্ত্রটা তুলে নিয়ে ফের বাগিয়ে ধরেছে। দুলালবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “এঃ হেঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে হে।”
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজকের দিনটাই দেখছি অপয়া।” হরেন কর্মকার মৃদু একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলল, “সেটা যদি বুঝতে পেরে থাকে, তা হলে এক মিনিটের মধ্যে আমার দোকান থেকে বেরোও। নইলে পুলিশে দেব।”
দুলালবাবু একটু হেসে অমায়িকভাবে বললেন, “তাই ডাকো হরেনভায়া, সেইটেই ভাল হবে। আমি বরং পাঁচুকে বেঁধে ফেলে পাহারা দিতে থাকি, তুমি ততক্ষণে গিয়ে চট করে পুলিশ ডেকে আনো। এসব লোককে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। তোমার দয়ার শরীর, জানি। তবু বলি, সমাজের ভালোর জন্যই এইসব লোককে যখন-তখন ক্ষমা করে দেওয়াটাও কাজের কথা নয়। যাও, তুমি বেরিয়ে পড়ো। আর দেরি করো না।”
হরেন গম্ভীর হয়ে বলল, “ওসব চালাকি আর খাটবে না। যা বলছি শোনো, এক মিনিটের মধ্যে যদি বেরিয়ে না যাও তো আমি গুলি চালাব।”
“এই যে বললে পুলিশ ডাকবে।”
“বলেছিলাম বটে, তবে ভেবে দেখলাম, যা করার নিজের হাতেই করা ভাল। গত বছর এক জ্যোতিষী আমার হাত দেখে বলেছিল বটে যে, আমার হাতে নরহত্যা আছে। তখন বিশ্বাস করিনি। এখন মনে হচ্ছে, কথাটা মিথ্যে বলেনি, আছেই যখন নরহত্যা, তখন ঘটেই যাক আজ।”
এই বলে হরেন তার অস্ত্রটা তুলে দুলালবাবুর দিকে তাক করল।
দুলালবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “নলটা আমার দিকে তাক না করে তোমার উচিত ছিল পাঁচুর দিকে তাক করা। আমি মানুষ তো খারাপ নই হে হরেনভায়া। সুযোগ পেয়েও তোমায় রদ্দা মারলুম না, নিজের চোখেই তো দেখলে। যাকগে, কলিকালে কারও ভাল কতে নেই। মানুষ বড্ড নেমকহারাম হয়ে গেছে। চলে হে পাঁচু, হরেনভায়ার এখানে আর সুবিধে হবে না।”
পাঁচু বিবেচকের মতোই ঘাড় নেড়ে বলল, “আমারও তাই মত। যেখানে লাভের আশা নেই সেখানে সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না।”