বলে বাস্তবিকই হরেন তার রিভলভারের ঘোড়া টিপে দিল। পাঁচু বিপাক বুঝে আগেই মেঝেয় শুয়ে পড়েছিল। এবার চোখ বুজে ফেলল। ভয় হল, দুলালবাবুর লাশটা নির্ঘাত তার ঘাড়েই এসে পড়বে। রক্তক্তও লেগে যেতে পারে। সে তো গেল একটা ঝামেলা। তারপর খুনের মামলায় সাক্ষীটাক্ষি দেওয়ার হ্যাপাও কি কম? নাঃ, দুলালবাবুর সঙ্গে কাজ কারবারে নামাটাই একটা মস্ত ভুল কাজ হয়েছে।
‘ঢিসুম’ শব্দ করে হরেনের রিভলভারের গুলি ছুটল। তবে হরেনের কাঁপা হাতের গুলি কারও কোনও ক্ষতি করল না। দরজা দিয়ে উড়ে গিয়ে উলটো দিকের একটা চালাঘরের চালে গিয়ে সেঁধোল।
কিন্তু হরেন ভাবল, তার গুলিতে নির্ঘাত লোকটা মরেছে। জীবনে এই প্রথম তার গুলি ছোঁড়া। শব্দে সে নিজেই ঘাবড়ে গেল। চোখ বুজে রিভলভারটা ফেলে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল সে। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে “রাম রাম, হরি হরি” করতে লাগল। নরহত্যার মতো পাপ নেই। আর তার হাতেই কিনা আজ একটা নরহত্যা হয়ে গেল! এই হাতে যে রোজ সকালে ঠাকুরের ফুল তোলে, লক্ষ্মীনারায়ণের পট পরিষ্কার করে, নারায়ণশিলাকে দুবো-গঙ্গাজলে স্নান করায়। এখন এই খুনে হাত দিয়ে আর কি সেসব পুণ্যের কাজ করা যাবে? ঠাকুর কি আর তার দিকে মুখ তুলে চাইবেন? ছিঃ ছিঃ, এ কী হল? না-হয় যেতই কয়েক হাজার টাকা, কিছু সোনাদানা আর হিরে-জহরত! গেলেও অনেক থাকত হরেনের। কিন্তু নরহত্যা করে যে সে নিজের স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাটাই বন্ধ করে দিল। তার মতো পাতকীকে এখন ক’হাজার বছর নরকবাস করতে হয় কে জানে!
ভাবতে-ভাবতে হরেন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
হরেনের দুঃখ দেখে দুলালবাবুও স্থির থাকতে পারলেন না। সামনের লোহার বেড়াটা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে ক্যাশবাক্সের ওপর বসে হরেনের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “কেঁদো না হে হরেন, কেঁদো না। জানি তুমি হিসেবী মানুষ, একটু-একটু কিপ্টেও, একটা গুলি খরচ হয়ে যাওয়ার শোকটা সামলাতে পারছ না। কিন্তু আমি বলি কি, একটা গুলির কীই বা এমন দাম! দু-আড়াই টাকার বেশি হবে কি? তা বেঁচে থাকতে গেলে ওরকম দু-আড়াই তো ভাই কতদিক দিয়েই যায়। ভেবে কী করবে?”
হরেন দু’হাতে মুখ ঢেকেই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দু-আড়াই গেছে যাক, কিন্তু একটা নরহত্যা হয়ে গেল যে! মহাপাপ হয়ে গেল। এখন কী হবে।”
দুলালবাবু বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, “তাই বলো। পাপ নিয়ে ভাবছ! ভাই রে দুনিয়াতে এমন কোনও সমস্যাটা আছে যার সমাধান নেই? নরহত্যা, মিথ্যে কথা, চুরি-জোচ্চুরি সব কিছুরই নিদান আছে, আমি বলি কি ভায়া, কিছু মূল্য ধরে দাও, তা হলেই পাপটাপ সব কেটে যাবে। বেঁচে থাকতে গেলে ওরকম দু চারটে নরহত্যা না করে উপায়ই বা কী?”
হরেন যেন একথায় একটু শান্ত হল। লাল দু’খানা চোখ মেলে বলল, “নরহত্যার রেট কত জানেন?”
একগাল হেসে দুলালবাবু বললেন, “তা আর জানি না ভায়া! এই কর্ম করে করেই তো চুল পাকিয়ে ফেললুম। তা হাজার-পাঁচেক যদি ছাড়ো তো লাশ-টাশ একদম গুম করে ফেলব। কেউ টেরটিও পাবে না।
হরেন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে বড় বড় চোখে চেয়ে বলল, “কিন্তু আপনি তো মরেননি! দিব্যি বেঁচে আছেন।”
দুলালবাবু মুখটা গোমড়া করে বললেন, “ভাই রে, আমি মরলে তবু ভাল ছিল। যাকে মেরেছ সে আমার গুরু। ওই দ্যাখো, পাঁচু মোদকের লাশ পড়ে আছে। যে-সে লোক তো নয়, কাঁচা-খেকো তান্ত্রিক। মাটি থেকে চার হাত শূন্যে উঠে ভাসতে ভাসতে ধ্যানজপ করে, শবসিদ্ধ পিশাচসিদ্ধ যোগীপুরুষ। এমন মানুষকে মারলে পাপ কতগুণ বেড়ে যায় তা জানো? আমাকে মারলে যদি তোমার এক কেজি পাপ হয় তো পাঁচু মোদককে মারলে হয় পঁচাত্তর কেজি। পাঁচ হাজার রীতিমত কমই বলেছি হে।”
হরেন একটু কিন্তু কিন্তু করতে লাগল। বলল, “লোকটা যে সত্যিই মরেছে তার প্রমাণ কী? আমি তো ওর দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়িনি।”
দুলালবাবু বললেন, “আমাকে ফসকে গিয়ে ওকেই লাগল কিনা। একেবারে মাথা ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। দ্যাখো না, কেমন দাঁত ছরকুটে পড়ে আছে। আর দেরি কোরো না ভায়া, বন্দুকের শব্দ বহুদূরে যায়। লোকজন এসে পড়ার আগেই লাশ সরাতে হবে। পরের জন্য খেটে খেটেই গেলুম।”
“কত বললেন?”
“পাঁচ হাজারই দাও। প্রাণের দাম তার চেয়ে ঢের বেশি।”
ঠিক এই সময়ে “এঃ, এই লোকটা কেবল আমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে” বলে হরেনের পাহারাদারদের একজন সটান উঠে বসল।
পাঁচু লোকটাকে কাতুকুতু মোটেই দেয়নি। তার কোমরের কাছে একটা মশা কামড়েছে। সে চুলকোচ্ছিল। লোকটা পাশেই ছিল বলে হাতটা একটু লেগে গেছে হয়তো। কিন্তু সে প্রতিবাদ না করে মড়া সেজে পড়ে রইল।
কিন্তু লোকটা মহা ত্যাঁদড়। উঠে বসে তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “এই লোকটা, ওঠো, উঠে পড়ো। অনেকক্ষণ ধরে বদমায়েশি করে যাচ্ছ।”
পাঁচু একটা চোখ খুলে লোকটাকে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, “আমি না। আমি কিছু করিনি। ওই লোকটা করেছে।” বলে দুলালবাবুকে দেখিয়ে দিল।
পাঁচুর কথা শুনে পাহারাদারটা দুলালবাবুর দিকে চাইল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই লোকটাই তো! একটু আগে বেকায়দায় পেয়ে আমাকে রদ্দা মেরেছিল। তবে রে…।”
বলে লোকটা এক লাফে লোহার বেড়াটা ডিঙিয়ে দুলালবাবুকে জাপটে ধরল।