বলতে বলতে দুলালবাবু হাতটাত ঝেড়ে হাসি-হাসি মুখে দোকানে ঢুকলেন। ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি।
পাঁচু চোখ চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কারণ সে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, হরেন কর্মকার তার রিভলভারটা বের করে ইতিমধ্যে বাগিয়ে ধরেছে আর বাঘা চোখে দুলালবাবুর কীর্তিকলাপ লক্ষ করছে। হরেন পাকা লোক, খামোখা ঘাবড়ে গিয়ে চেঁচামেচি করেনি। দরকার হলে তার হয়ে হাতের অস্ত্রটাই কথা কইবে।
কিন্তু দুলালবাবুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হরেন কর্মকারের দিকে চেয়ে বললেন, “তা ভাল আছ তো হরেনভায়া? অনেকদিন বাদে দেখা। একটু শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে যেন! তা ভাল। বয়স হলে রোগা হওয়া স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তা আর সব খবরটবর কী? কাজ কারবার তা হলে ভালই চলছে! অ্যাঁ?”
হরেন তার অস্ত্রটা আর-একটু শক্ত করে ধরে ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনি কে? এখানে আগমনই বা কিসের জন্য?”
দুলালবাবু ভারি অভিমানের গলায় বললেন, “সে কী! আমাকে চিনতে পারছ
হরেনভাই? কলিকালটা যে বড়ই জাঁকিয়ে বসেছে বলে মনে হচ্ছে! সেই যে গো, বছর-পনেরো আগে আমার মরা মায়ের একজোড়া কানপাশা বাঁধা রেখে তোমার কাছ থেকে পঞ্চাশটা টাকা কর্জ করেছিলুম, মনে নেই! সুদে-আসলে দেড়শো টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। সে আর জোগাড় হল না বলে কানপাশা দুটো তুমি গাপ করে ফেললে!”
হরেন কর্মকার ঠাণ্ডা গলাতেই বলল, “জিনিস বাঁধা রাখাই আমার ব্যবসা। দিনরাত হাজারটা লোক আসছে। সবাইকে মনে রাখা আমার কাজ নয়।”
“সে কী হে! দুলাল-মাস্টারকে ভুলে গেলে হে হরেন? এরপর তো নিজের মায়ের পেটের ভাইকেও চিনতে পারবে না! কলিকালে যে কত কী হয়! তা সে কথা থাক ভায়া, কাজের কথাটাই বরং হয়ে যাক। ওই যে দেখছ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ভালমানুষের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, ও হল পাঁচু মোদক। মুখ দেখে কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না রে ভাই, একেবারে বিচ্ছু একটি। দিনে-দুপুরে রাহাজানি করে বেড়ায়। আর আমি হলুম যে, ওরই শাগরেদ, দুলাল গুণ্ডা। হেঁ হেঁ। রাজযোটক যাকে বলে।”
হরেন দরজার কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা তার দু-দুটো দরোয়ানের দিকে একবার করুণ নয়নে চাইল। তারপর রিভলভারটা দুলালবাবুর দিকে তাক করে বলল, “আমি পোড়-খাওয়া লোক, অনেক দেখেছি, অনেক শয়তান বদমাশকে ঢিটও করেছি। এখানে খুব সুবিধে হবে না। মাথার ওপর হাত তুলে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান, নইলে গুলি চালাব।”
দুলালবাবু একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর দুঃখিত গলায় বললেন, “তোমাদের দরোয়ানদের নয় ভদ্রতাবোধ নেই, তা বলে তুমিও কি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেললে ভায়া? অতিথি হল নারায়ণ। আগের দিনে অতিথি-অভ্যাগতদের কত সম্মান ছিল। কলিকালে দেখছি সবই গেছে। তা তায়া, অতিথি-সকার না-হয় না-ই করলে, কিন্তু একটু বসতে তো দেবে, একটু জলটল তো খাওয়াবে! এ কী ব্যবহার তোমার!”
হরেন রিভলভারের ঘোড়ায় আঙুলটা কি একটু জোরেই টিপে ধরল? পাঁচু সভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল আবার। না, পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে আজ আর বোধহয় ফেরা যাবে না।
হরেন গর্জন করে উঠল, “খবর্দার! আর এগোলে কিন্তু…”
দুলালবাবু হরেনের হুমকি অগ্ৰহ্য করে তবু এক পা এগিয়ে গিয়ে একগাল হেসে বললেন, “আমি জানি হে হরেন, তোমার বড় দয়ার শরীর। তুমি পিঁপড়ে পর্যন্ত মারতে শেখোনি। ওইসব বন্দুক পিস্তল কি ভাই তোমার হাতে শোভা পায়? বড় বিপজ্জনক জিনিস। ও তুমি রেখে দাও বাক্সের মধ্যে। ওসব ঘাঁটাঘাঁটি করলে মনের মধ্যে জিঘাংসা আসে, নিরীহ লোকের মাথাতেও খুন চেপে যায়। রেখে দাও ভাই। অনেকদিন বাদে তোমাকে দেখে ভারি ভাল লাগছে। আঙুল ফুলে কলাগাছটি হয়েছে, দিব্যি ফলাও কারবার ফেঁদে বসেছ, দু’পয়সা আসছে, এ দেখেও চক্ষু সার্থক।”
হরেন এবার বাস্তবিকই চঞ্চল হল। কথাটা ঠিকই যে, সে কখনও খুন-খারাপি করেনি। দরকারও হয়নি বড় একটা। এখনও করতে চাইছে না। শুধু ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু লোকটা যে কেন ভয় পাচ্ছে না, তাও বুঝে ওঠা দুষ্কর। সে এবার। একটু কাঁপা গলায় বলল, “এবার ভয় না পেলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
দুলালবাবু খুব হাসলেন। একেবারে খিকখিক করে হাসতে লাগলেন। যেন এরকম মজার কথা জীবনে শোনেনি। তারপর গদগদ করে বললেন, “তোমাকে ভয় পাব! কেন হে হরেন? তোমার মতো একজন নিরীহ সজ্জনকে ভক্তি করব, শ্রদ্ধা করব, কিন্তু ভয় পাব কেন? এই যে তুমি এত উন্নতি করেছ, এতে কি আমার আনন্দ হচ্ছে না? আমি গর্ব অনুভব করছি না? খুব করছি হে হরেন, খুব করছি। বাঙালির আজ ভারি দুর্দশা। তার মধ্যে তুমি যে উন্নতি করেছ, এটা যে খুব আশার কথা ভাই। ভয়ের কথা এখানে উঠছে কিসে?”
ওই বলে দুলালবাবু দু’হাত বাড়িয়ে একেবারে প্রেমানন্দে হরেনের দিকে এগিয়ে গেলেন, বললেন, “এসো এসো ভাই, বাঙালির গৌরব, আমাদের গৌরব, এসো কোলাকুলি করি। আমার মায়ের কানপাশাজোড়া গাপ করেছ বটে, কিন্তু আমি ভাই চৈতন্যদেবের ওই কথাটা বড় বিশ্বাস করি, মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না….”
হরেন সভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রিভলভার তুলে বলল, “খবর্দার বলছি, ভাল হবে! খুন হয়ে গেলে কিন্তু আমাকে দায়ী করতে পারবেন না বলে দিচ্ছি। এই তবে ছুঁড়লুম গুলি…..”