“দুলালবাবু, একটু দাঁড়ান, হাঁফ ছেড়ে নিই।”
“‘আমার যে আরও দৌড়তে ইচ্ছে করছে হে পাঁচু! আমি যে এখনও মাইল দশেক দৌড়তে পারি।”
“লাভ কী? ক্ষমতার অপচয় করতে নেই। তেনারা সব পিছিয়ে পড়েছেন!” দুলালবাবু একটু লাজুক গলায় বললেন, “লোকগুলো কে বলো তো পাঁচু?”
“আজ্ঞে, এখন আর এঁরা লোক নন, পরলোকের লোক। তবে আপনি ভারি একটা উপকারও করেছেন আমার। ওই গাছটাতেই যে তেনাদের বাসা, সেটা টের পাইনি এতদিন। পেয়ে খুব ভাল হল। ভূতের কারবারে কাঁচা পয়সা।”
দুলালবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তবে চলো একটা থলে নিয়ে গিয়ে সব ক’টাকে ভরে ফেলি।”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “আগেই বলেছি আপনাকে, সব কাজে তাড়াহুড়ো করতে নেই। এখন যদি ফিরে যান তবে তেনারা রাগের মাথায় এখন ছিঁড়ে ফেলবেন। ঘাপটি মেরে থাকুন। তেনারা আবার ঠাণ্ডা হয়ে গাছে উঠে গুটি পাকিয়ে ঘুমোতে থাকুন, পরে ব্যবস্থা হবে।”
“বলছ।”
“বলছি।”
“কিন্তু এখন তবে কী করা যায়?”
“চলুন, ওই রকটায় বসে একটু ভাবি। সব কাজ কি গায়ের জোরে হয়? বুদ্ধি খাটাতে হয়।”
রাত খুব বেশি হয়নি। তবে মফস্বলের শহর আর শীতকাল বলে এর মধ্যেই চারদিকটা বেশ নির্জন হয়ে গেছে। বাজারের দোকানপাটও সবই প্রায় বন্ধ। দু একটা খোলা আছে মাত্র।
দু’জনে রক-এ বসে ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পাঁচু বলল, “দুলালবাবু।”
‘হুঁ।”
“বাজারের শেষ মাথায় হরেন কর্মকারের দোকানে এখনও আলো জ্বলছে, দেখতে পাচ্ছেন?”
“পাচ্ছি।”
“হরেনের মেলা টাকা। রাত্রিবেলা যখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে তখন কোমরের গেঁজের মধ্যে দশ-বিশ হাজার টাকা হেসে খেলে থাকে।”
দুলালবাবু উঠে পড়তে-পড়তে বললেন, “তাই নাকি? তবে তো দেখতে হচ্ছে।”
পাঁচু হাত তুলে বলল, “দাঁড়ান, আরও কথা আছে। হরেনের সঙ্গে দুটো বিশ্বাসী পাহারাদার থাকে। তাদের হাতে লাঠি, কোমরে ভোজালি।
দুলালবাবু একটা তাচ্ছিল্যের ভাব করে বললেন, “ফুঃ! মোটে দুটো পাহারাদার। ও আমি এক লহমায় উড়িয়ে দেব।”
বিচক্ষণ পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “কাজটা সহজ হবে না দুলালবাবু। হরেনের কাছে ছোট বন্দুকও আছে। কৌশল করা ছাড়া উপায় নেই।”
“কৌশলটা কী?”
“আপনার হাতে একটা আংটি দেখছি। ওটা কি সোনার আংটি?” দুলালবাবু বললেন, “হ্যাঁ সোনা বইকী!
“তা হলে ওটা খুলে নিয়ে সোজা হরেনের কাছে চলে যান। ও সোনা বাঁধা রাখে। বাঁধা দেওয়ার নাম করে লোকটাকে পরখ করে নিন। তারপর কথাটথা বলতে থাকুন। সুযোগের সন্ধান করতে থাকুন।”
দুলালবাবু অধৈর্য হয়ে বললেন, “ওসব আমার পোষাবে না। কথাটথা আমার আসে না। আমি চাই কাজ।”
“তা হলে আংটিটা আমার হাতেই দিন! আমি গিয়ে ব্যাপারটা একটু বুঝে আসি। ভয় নেই, আংটি নিয়ে পালাব না। আমার ঘাড়ে তো একটা বই দুটো মাথা নেই।”
দুলালবাবু হেলাভরে আংটিটা খুলে পাঁচুর হাতে দিয়ে বললেন, “সামান্য আংটিও তোমাকে গুরুদক্ষিণাই দিলাম ধরে নাও। সামান্য আংটি গেলে যাক, তার বদলে যদি কয়েক হাজার টাকা আসে।”
পাঁচু আংটিটা নিয়ে উঠল, গুটিগুটি গিয়ে সে যখন হরেনের দোকানে ঢুকল, তখন হরেন একটা হিরে বা মুক্তো মন দিয়ে দেখছে। সামনে দু’জন খদ্দের বসা। দরজায় দুটো ভোজপুরি দারোয়ান। তাদের চোখ একেবারে বুকের ভিতরে এসে সেঁধোয়।
হরেন পাঁচুকে পাত্তাও দিল না! পাথরটা রেখে সে খদ্দেরদের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল, পাঁচু দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। সে ধৈর্যশীল লোক। জানে সবুরে মেওয়া ফলে। তবে দাঁড়িয়ে থেকে সেসব দিকে চোখ রাখছিল। কোথায় কী আছে, কী থাকতে পারে।
অনেকেক্ষণ বাদে খদ্দেররা বিদায় নিলে হরেন পাঁচুর দিকে চেয়ে চোখ ছোট করে বলল, “কী হে, তোমার মুখোনা যেন চেনা-চেনা ঠেকছে।”
“আজ্ঞে, এই বাজারেই পান বেচি।”
“বটে! তবে কী মনে করে?”
“একটু বিপদে পড়ে গেছি হঠাৎ। বড্ড টাকার দরকার।”
“বটে! দরকার ছাড়া আর এই অধমের কাছে কে আসবে বলো। তা জিনিসপত্তর কী এনেছ?”
“এই আংটিটা। আমার দাদামশায়ের জিনিস, সাবেক মাল।”
হরেন আংটিটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড মাত্র দেখল, তারপর কষ্টিপাথরে ঘষে রংটা দেখে বলল, “অনেক ভেজাল আছে হে, তা কত চাও?”
“আজ্ঞে দু-চার হাজার যা দেবেন।” হাজার শুনে হরেন অট্টহাস্য করে উঠল। মিনিটখানেক সে হাসির দমকে কথাই বলতে পারল না। তাতে তার গায়ের ফতুয়া ভূঁড়ির ওপরে উঠে গেল। কোমরের গেজেটা টপ করে দেখে নিল পাঁচু। তার আন্দাজ নির্ভুল। গেজেতেই মালপত্র থাকে তা হলে।
হরেন হাসি থামিয়ে আংটিটা ফেরত দিয়ে বলল, “তুমি বেশ মজার লোক হে। এই আংটিতে দু-চার হাজার টাকা যে চায় তার স্থান হল পাগলাগারদ। যাও তো, এখন আমি উঠব।”
“যে আজ্ঞে।” বলে পাঁচু উঠল।”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই বাধা পড়ল। দুই দরোয়ান একসঙ্গে “এই, এই’’বলে চেঁচিয়ে উঠল বিকট স্বরে।
পাঁচু চোখ বুজে ফেলল।
চোখ বুজলেই কি আর রক্ষে পাওয়া যায়? পাঁচু চোখ বুজেও রেহাই পেল। কান তো আর বন্ধ নেই। শুনতে পেল দুমদাম দমাস সব সাঙ্ঘাতিক শব্দ। দুলালবাবু হেঁড়ে গলায় চেঁচাচ্ছেন, “আমাকে রুখবি এত ক্ষমতা তোদের? অ্যাঁ! এই দিলুম এক ঘুষো… কেমন বুঝছিস রে পাজি?…… ওরে ছুঁচো, আমাকে ল্যাং মারা হচ্ছে? এই নে, তোকেও দিলুম এক রদ্দা….কেমন লাগছে রে? ছ্যাঃ, দু দুটো মুশকো জোয়ান তোরা, দু’বেলা নিশ্চয়ই ভরপেট খাস, ডন বৈঠক দিস, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেলি বাবা! না, না, হরেন, এ কোনও কাজের কথা নয়, এই দরোয়ান তোমার চলবে না…”