এই সময়ে কে যেন পিছন থেকে মোলায়েমভাবে দুলালবাবুর পিঠে তিনটে টোকা দিয়ে অমায়িক গলায় বলল, “আজ্ঞে দুলালবাবু, যে পরিমাণ চেঁচামেচি
করছেন তাতে যে গণেশ ভয় খেয়ে আকাশে তিন মাইল ওপরে উঠে গেছে।” দুলালবাবু বিরক্ত হয়ে ফিরে দেখলেন, পাঁচু গম্ভীর ও করুণ মুখে দাঁড়িয়ে।
“কী বললে?”
“বলছিলুম, আপনার চেঁচামেচিতে ভূত হাওয়া। আমি দুশো টাকা দর দিয়েছিলুম, এখন তো দু’পয়সাও আশা নেই।”
দুলালবাবু ফটিকবাবুকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ভূতটা তা হলে গেল কোথায়?”
“বললুম তো পালিয়েছে।”
দুলালবাবু খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললেন, “ভূতটাকে বলল, ফের যদি পালায় তা হলে আমি তাকে আস্ত রাখব না।”
“বলব খন।”
“আর কাল যেন সে অবশ্যই এখানে হাজির থাকে। নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
ফটিকবাবু সভয়ে বাক্যহারা হয়ে দৃশ্যটা দেখছিলেন। বললেন, “আমি কালও ভূত দেখতে চাই না। ভূত দেখার ইচ্ছে চলে গেছে।”
“চোপ!” বলে তাঁকে একটা পেল্লায় ধমক মারলেন দুলালবাবু।
ফটিকবাবু আবার পিছোলেন।
দুলালবাবু পাঁচুর দিকে চেয়ে বললেন, “চলো তা হলে আমার অন্য কাজে যাই।”
“কী কাজ?”
“চুরি-ডাকাতি যা হোক। কিছু তো করতে হবে।”
পাঁচু খুবই ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “আপনার দোষ কী জানেন দুলালবাবু, সব ব্যাপারই বড় তাড়াহুড়ো করেন। ভূতের কারবারটায় জলের মতো দুদুশোটাকা চলে আসছিল হাতে, আপনি নাক গলিয়ে বারোটা বাজালেন। এসব কাজে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ধীর স্থিরভাবে কাজ করতে হয়। খুব সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচের ব্যাপার কিনা। কথার একটু এদিক-ওদিক হলেই মক্কেল সন্দেহ করতে শুরু করবে, পিছিয়ে যাবে, শেষে পালাবে।”
দুলালবাবু একটু অপ্রস্তুত মুখে বললেন, “তাবটে হে পাঁচু, কাজটা খারাপই করলাম। তবে আমাদের আয়ুটাও যে বেজায় কম। এত কম সময়ে কত কাজ করার আছে বলো তো। ওই হাড়কেপ্পন ফটিকের পিছনে মূল্যবান সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।”
পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “একটা ভুল করে ফেলেছেন, কিছু বলছি না, কিন্তু এরপর কথাবার্তা যা বলার তা আমিই বলব, আপনি পিছনে থাকবেন।”
“তাই হবে হে পাঁচু, কিন্তু এখন কী করা যায় বলো তো! কিছু একটা না করলে যে শরীরটা ঠাণ্ডা হবে না। চলো, কাউকে ধরে কিছুক্ষণ খুব পেটাই, তাতে শরীরটা ধাতস্থ হবে, মাথাটাও ঠাণ্ডা হয়ে আসবে।”
পাঁচু গম্ভীরতর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আমাদের শাস্ত্রে আছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে হয়। ঠিক সময়ে ক্ষমতা কাজে লাগে।”
দুলালবাবু করুণ স্বরে বললে, “কিন্তু আমার হাত-পা যে বড্ড নিশপিশ করছে। কীরকম জানো? অনেকটা সুড়সুড়ির মতো। কিছু না করলে বড় কষ্ট হবে।”
পাঁচু বুঝদার মানুষ। দুলালবাবুকে এখনই একটু হাঙ্গামায় নামাতে না পারলে উনি আরও কিছু কেলেঙ্কারি করে বসতে পারেন। তাই সে বলল, “খুব উচাটন হয়ে থাকলে একটা কাজ করুন। ওই যে ঝুপসিমতো গাছটা দেখছেন ওটার গায়ে কয়েকটা ঘুসিটুসি মেরে আসুন।”
“মারব?” বলে দুলালবাবু রোষকষায়িত লোচনে গাছটার দিকে একবার তাকালেন। তারপর একটা হুঙ্কার দিয়ে গিয়ে কয়েকটা ঘুসি বসিয়ে দিলেন গাছটার গায়ে। বললেন, “তবে রে! তোরই একদিন কি আমারই একদিন!”
দুলালবাবুর গায়ে এখন সাঙ্ঘাতিক জোর। তাঁর ঘুসির চোটে গাছটা থরথর করে কেঁপে উঠল। গাছে যত পাখি ছিল তারা কিচিরমিচির করে চেঁচাতে লাগল। আর গাছ থেকে বড় বড় সব গোল ও কালো ফল ধপাধপ পড়তে লাগল মাটিতে।
ফল দেখে দুলালবাবু খুশি হয়ে বললেন, “ওহে পাঁচু, দেখেছ কত ফল পড়েছে। কী ফল বলো তো! এরকম কালো আর বড় ফল তো জন্মেও দেখিনি! এ কি খাওয়া যায়?
পাঁচু কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “আজ্ঞে, ও হল জিকা গাছ। কস্মিনকালেও ও-গাছে ওরকম ফল হয় না।”
“হয় না, তা হলে ফল পড়ল কী করে?”
“সেটাই তো ভাবছি।”
ভাবতে হল না। ফলগুলো পড়ে নিজে থেকে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ ফট করে একটা ফল যেন ফেটে গেল। ভিতর থেকে খানিকটা ধোঁয়ার মতো জিনিস বেরিয়ে এসে লম্বা সুড়ঙ্গে একটি চেহারা ধরে ফেলল। সেই চেহারা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। দু’খানা ভাটার মতো চোখ ধকধক করে জ্বলছে।
পাঁচু দৃশ্য দেখে হাঁ, দুলালবাবু মাথা চুলকোতে লাগলেন।
মূর্তিটা খখানা স্বরে বলল, “কে রে? কার এত বুকের পাটা? দেড় হাজার বছরের ঘুমটা মাটি করলি হতভাগা? আজ তোর মুণ্ডু যদি চিবিয়ে না খাই তবে আমার নাম পতিতপাবনই নয়।”
দেখতে-দেখতে অন্য ফলগুলোও ফটাফট ফাটতে লাগল আর একে একে সুড়ঙ্গে সুড়ঙ্গে সব মূর্তি সুড়ত সুড়ুত করে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারা যে বেজায় অসন্তুষ্ট, তা তাদের চেঁচামেচি আর হাবভাবে বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছিল।
পাঁচু একটু চাপা গলায় বলল, “দুলালবাবু, ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না!”
“আমারও না।”
“কেটে পড়াই ভাল।”
“আমিও তাই বলি।”
“কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে কাজটা ভাল করেননি।”
“তুমিই তো গাছে ঘুসি মারতে বললে হে।”
মূর্তিগুলো কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে সঠিক বুঝতে পারছিল না, কীর্তিটা কার। তাই নিজেদের মধ্যেই একটু ঝগড়া বিবাদ করছিল। সেই ফাঁকে পাঁচু আর দুলালবাবু দৌড় লাগালেন।
বাজারের কাছ বরাবর পোঁছে দুলালবাবু পাঁচুর ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পাঁচু পিছিয়ে পড়েছিল।