হরমোহিনী দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ডাকাতটা সামনেই পড়ে আছে দেখে হরমোহিনী ঠ্যাঙাটা তুলে বললেন, “দেখলি তো, কেমন ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! এবার দিই মাথাটা ভেঙে!”
‘ঠাকুমা মেরো না।”
“বিপদে পড়ে ঠাকুমা বলে ডাকলেই কি আর আমি ভুলি রে বাপু! তোরও। আক্কেল নেই! রোজ রোজ একটা বাড়িতে এসে হামলা করিস কেন রে বেআক্কেলে? কেন, ওই তো হরিপদ পালের অত বড় আড়ত রয়েছে, কালী স্যাকরার দোকান। রয়েছে, রহিম শেখের তেজারতি রয়েছে, সেসব তোর চোখে পড়ে না? কানা নাকি? এ বাড়িতে কিসের মধু রে অলপ্লেয়ে?”
“ঠাকুমা, আমি নন্দ।”
“নন্দ! বলিস কী? তুই নন্দ হতে যাবি কোন্ দুঃখে?”
নন্দবাবু শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভেজা গায়ে উঠে দাঁড়ালেন। ককিয়ে উঠে বললেন, “ও মাজাটা গেছে, হাঁটুটার অবস্থাও ভাল নয়। ও, তারপর ভূতের তাড়া।”
হরমোহিনী নাতিকে চিনতে পেরে ঠ্যাঙাটা নামিয়ে বললেন, “তাই তো! তুই তো নন্দই মনে হচ্ছে।”
“নন্দই বটে গো ঠাকুমা, তবে নিজের নামটা ভুলবারই জো হয়েছে। সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।”
“আয় ভাই, ঘরে আয়। দিনকাল ভাল নয়, অমন দৌড়াদৌড়ি হুটোপাটি করতে আছে?”
নন্দবাবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন। আর সেই সময় খাটের তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ভুবনবাবুও বেরিয়ে আসছিলেন। নন্দবাবু দেখে হাঁ, নিজের ডাকসাইটে বাবাকে এরকম হামাগুড়ি দিতে জীবনে দ্যাখেননি।
ভুবনবাবুও যথেষ্ট লজ্জা পেয়েছেন। সেটা ঢাকা দিতেই ভ্রূকুটি করে গম্ভীর মুখে বললেন, “ভূতের কথা কী বলছিলে? তোমাদের দুই ভাইকেই দেখছি আজকাল বেশ ভূতে ধরেছে। ব্যাপারটা কী বলো তো!”
নন্দবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “আজ্ঞে, ভৌত-ক্লাবে আজ যথার্থই ভূত এসেছিল।”
ভুবনবাবু অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “এই বিজ্ঞানের যুগে তোমরা যে কী করে ভূতে বিশ্বাস করো তা আমি তো ভেবেই পাই না। কাজকর্ম না করে তুমি বায়ুগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছ। ভীতু, অলস, নিষ্কর্মা…”
হরমোহিনী অত্যন্ত কঠোর গলায় ডাকলেন, “ভুবন! কোন্ সাহসে আমার সামনে তুই বাচ্চাটাকে বকছিস!”
ভুবন রায় সঙ্গে সঙ্গে কেঁচো হয়ে গেলেন। এ বাড়িতে বড়দের সামনে ছোটদের মেজাজ দেখানোর রেওয়াজ নেই।
হরমোহিনী অত্যন্ত কঠোর গলায় বললেন, “খুব পণ্ডিত হয়েছিস না? ভূত প্রেত নেই তোকে কে বলল? না থাকলে তোর বাবা, তোর দাদু, তোর জ্যাঠা, তোর ঠাকুমাকে আমি রোজ দেখতে পাই কেন? তারা যে সর্বদা ঘুরঘুর করে চারদিকে। এই তো কাল রাতেও শুনলুম, তোর দাদু কাসছে পাশের ঘরে। ভাবলুম, গিয়ে একটু তেল মালিশ করে দিয়ে আসি বুকে। তারপর মনে হল, বায়ুভূত অবস্থায় মালিশটা ঠিকমতো বসবে না। তোর বাবা তো ফিরাতে এসে বলে যায়, “ওগো ভুবনটাকে দেখো, লেখাপড়া ঠিকমতো করছে তো! না কি কেবল খেলে বেড়াচ্ছে! বল তা হলে ভূত না থাকলে এসব হচ্ছে কোত্থেকে।”
.
ওদিকে ভৌত ক্লাবের দরজার বাইরে আর এক নাটক চলছে। পাঁচু পাঁচশো। টাকা থেকে দুশো টাকায় নেমে আসায় কে যেন পিছন থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আহাম্মক কোথাকার! ওভাবে দর কমাতে হয়!”
হ্যাঁচকা টানে পাঁচু অনেকটাই ছিটকে গিয়ে কুলতলায় পড়ে ভিরমি খেল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দেখল তার স্থান নিয়েছেন স্বয়ং দুলালবাবু।
দুলালবাবু ফটিকবাবুকে বেশ চড়া গলায় বললেন, “ওই পাঁচশোই, এক পয়সাও কম নয়। ভূত দেখতে চাও তো টাকাটা ফ্যালো হে ফটিক।
ফটিকবাবু দুলালবাবুকে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন। কারণ আজ সকালেই এই লোকটা তাঁর ওপর বিস্তর হামলা করে এসেছে। লোকটাকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সেই নকল দুলাল আসল দুলালকে খুন করে লাশ সরিয়ে ফেলেছে।
ফটিকবাবু সভয়ে তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “আমি ভূত দেখতে চাই না।”
“আলবাত চাও। ভূত তোমাকে দেখতেই হবে।”
“আমি ভূত-টুত বিশ্বাসই করি না। আপনি যেতে পারেন। দুলালবাবু হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বললেন, “তা হলে শালার কাছে তোমার যে মাথা হেঁট হতে হবে হে ফটিক। সেটা কি ভাল হবে?”
“শালার কাছে মাথা হেঁট হয় হোক। আমি ভূত দেখতে চাই না। এখন আমি বাড়ি যাব, বড্ড খিদে পেয়েছে।”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু, সেটি তো হওয়ার উপায় নেই হে ফটিক। তুমি ভূত দেখতে চাও বলে সারাদিন ছোটাছুটি করে আমি আর পাঁচু মিলে কত কষ্টে একটা ভূত ধরেছি, এখন তুমি দেখতে না চাইলে হবে কী করে? পাঁচশো। টাকা না থাকে তো চারশো নিরানব্বই টাকা পঁচানব্বই পয়সাই দাও। একেবারে জলের দর। রিডাকশন সেল যাকে বলে।”
ফটিকবাবু আরও তিন হাত পিছোতে গিয়ে মড়ার খুলি ও মোমবাতিসহ টেবিলটায় ধাক্কা খেলেন। বললেন, “না-না, ভূত-টুত খুব খারাপ জিনিস। ও আমি দেখতে চাই না। যদি কেউ ভূত ধরে আমার সামনে নিয়ে আসে তাহলেও আমি চোখ বুজে থাকব।”
দুলালবাবু এখন আর আগের দুলাল নেই। গায়ের জোর যেমন বেড়েছে, তেমনি মেজাজটাও তিরিক্ষি হয়েছে। ফটিকবাবু পিছোচ্ছেন দেখে তিনি তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। এক লাফ মেরে ঘরে ঢুকে তিনি ফটিকবাবুর ঘাড়টা চেপে ধরে একেবারে শূন্যে তুলে ফেললেন, “ভূত দেখতে চাও না? তা হলে এতদিন ধরে সবাইকে বলে বেড়ালে কেন যে, ভূত না দেখলে তোমার পেটের ভাত হজম হচ্ছে না? অ্যাঁ! ভূত যদি না দেখতে চাও তা হলে তোমাকেই ভূতের দেশে পাঠাব।”