মোক্ষদা ধমক দিয়ে বলে উঠল, “তোমার কি মাথাটা একেবারেই গেল? ওমা, কোথা যাব গো! বলি বড়বাবুকে চিনতে পারছ না গলা শুনে! আর সাঁঝরাতে কি গেরস্তর বাড়িতে চোর ঢোকে?”
হরমোহিনী গলা তুলে বললেন, “দ্যাখ মোক্ষদা, ভুবনকে আমি পেটে ধরেছি, তার গলা আমি চিনব না তো কে চিনবে? বাছা আমার দিনে ক’বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় তারও হিসেব আমার আছে।”
“এতই যদি চেনো তা হলে লাঠি-ঠ্যাঙা চাইছ কেন?”
“সে তুই বুঝবি না। দিনকাল ভাল নয়। লোকটা ফশ করে ঢুকে পড়ার পর যদি দেখি, সে আমার ভুবন নয়, একটা মুশকোমতো ঝাঁটা গোঁফ মিশমিশে কালো আর ভাঁটার মতো চোখওয়ালা বিচ্ছিরি লোক, তখন কী হবে লা? চোরেরা কত লোকে গলা নকল করতে পারে তা জানিস?”
“খুব জানি গো, খুব জানি। চোরের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, লোক জানান দিয়ে মাঝের রাত্তিরে ঘরে ঢুকবে।”
ভুবনবাবু ঘরে ঢুকে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। হরমোহিনী তাঁর দিকে ফিরেও তাকালেন না। গায়ের লেপটা সরিয়ে ঠ্যাঙা হাতে উঠে বসলেন। তারপর মোক্ষদার দিকে চেয়ে দ্বিগুণ গলায় বললেন, “দ্যাখ মোক্ষদা, তুই হচ্ছিস সেদিনকার মেয়ে, তুই ক’টা চোর দেখেছিস র্যা জীবনে? চোর কতরকমের হয় তা জানিস?”
“আমার নাতির বয়স কত, তা জানো? খুব যে আমাকে কচি খুকি বলে উড়িয়ে দিচ্ছ, আর চোর তুমি আমাকে কী চেনাবে, চোর দেখে-দেখে চোখ পচে গেছে। এখন হাঁটুটা দাও, তেলটা মালিশ করে চলে যাই। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
কাজের কথায় কান দিলেন না হরমোহিনী। হাতের ঠ্যাঙাটা নাচাতে নাচাতে বললেন, “আমাকে আর কাজ দেখাস না মোদা, কী কাজ যে তুই করিস তা খুব জানি। আমার বাঁ হাটুতে ব্যথা আর তুই রোজ চুপিচুপি আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করে যাস। কাল রাতে চোর এল আর তুই পড়ে-পড়ে ঘুমোলি। আর আজ আমাকে যা নয় তাই বলে মুখে-মুখে জবাব করছিস। অতই যদি চোর দেখেছিস তবে বল দেখি চোরের কথা। তুইও বল, আমিও বলি। পাঁচজনে শুনে বলুক, চোরের কথা কে বেশি জানে।”
“আমারও বলে কাজ নেই, তোমার শুনে কাজ নেই। ওই বড়বাবু দাঁড়িয়ে আছেন, ঘরে আলো জ্বলছে, ভাল করে দেখে নাও।”
হরমোহিনী বললেন, “দেখার আবার কী আছে রে, নিজের পেটের ছেলে, সেই
এতটুকুন বেলা থেকে দেখে আসছি।”
“তাই তো বলছি গো, নিজের ছেলে চিনতে পারো না, তুমি কেমনধারা লোক?”
হরমোহিনী চোখ পাকিয়ে বললেন, “চিনতে পারিনি এ কথা তোকে কে বলল? হ্যাঁ রে ভুবন, আমি কি বলেছি যে, তোকে চিনতে পারিনি? আমার কি তেমন ভীমরতি ধরেছে?”
ভুবন রায় মাথা নেড়ে বললেন, “না তো।”
“ওই শোন্ মোদা, শুনলি তো। আমি আমার ভুবনকে চিনতে পারব না তাও কি কখনও হয়? তোর যে দিন-দিন কী আক্কেল হচ্ছে তাই ভাবি।”
মোক্ষদা গজ গজ করতে লাগল, “আমার আক্কেল ঠিকই আছে। তোমার আক্কেলেরই বলিহারি যাই। দিন-রাত হাতে ঠ্যাঙা নিয়ে বসে আছ। বলি চোর আসুক না আসুক, ভুল করে ঠ্যাঙাটা আবার কার মাথায় বসিয়ে দাও তার তো ঠিক নেই।”
‘আমি বুঝি সেরকম লোক! মানুষকে ধরে ধরে মাথায় ঠ্যাঙার বাড়ি মেরে বেড়াই বুঝি?”
“তা মোটেই বলিনি। চোখে ভাল দেখতে পাও না, কানেও ভাল শুনতে পাও না, বুদ্ধিও ঘোলাটে, এই বয়সে ভুলটুল তো হতেই পারে।”
“কবে আবার চোখে দেখলুম না, কবে আবার কানে শুনলুম না রে পাজি? নিয়ে আয় উঁচ সুতো, এক্ষুণি ছুঁচে সুতো পরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। আর কানের কথা বলছিস? একতলায় কেউ ফিসফিস করে কথা বললেও দোতলায় আমার কানে আসে।”
“ঘাট হয়েছে বাপু। তবু বলি, ঠ্যাঙাটা তোমার হাতে মোটেই আমার সুবিধে ঠেকছে না।”
ভুবনবাবু সারা দুনিয়ায় এই একটিমাত্র মানুষকে বড় সমঝে চলেন। তিনি হলেন তাঁর মা হরমোহিনী। ভুবনবাবু আশি ছাড়িয়েছেন সেই কবে, কিন্তু হরমোহিনী এখনও তাঁকে নিতান্তই নাবালক মনে করেন। শাসন-তর্জনও বড় কম করেন না।
মোক্ষদা আর হরমোহিনীর ঝগড়ায় ভুবনবাবুর কোনও ভূমিকা নেই। অথচ চলেও যেতে পারছেন না।
হরমোহিনী তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ রে ভুবন, আমি কি চোখে দেখি? কানে শুনি না? আমার কি বুদ্ধিনাশ হয়েছে?”
ভুবনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না মা, তোমার চোখ কান বুদ্ধি সবই ঠিক আছে।”
“তবে যে মোক্ষদা বলে! হ্যাঁ রে মোক্ষদা, ছুঁচ সুতো আনলি? নিয়ে আয়, তারপর দ্যাখ পিদিমের আলোতেও সুতো পরাতে পারি কি না, তারপর কানের পরীক্ষা…”
হরমোহিনীর কথা শেষ হল না, তার আগেই সিঁড়িতে দুদ্দাড় পায়ের শব্দ হল। কে যেন দৌড়ে আসছে। নীচের তলা থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “কে যায় ঐ কে যায় রে? ডাকাত নাকি?”
ভুবনবাবু আঁতকে উঠে ঘরের দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে গেলেন, তারপর চেঁচাতে লাগলেন, “ডাকাত! ডাকাত! সব দৌড়ে এসো….”।
হরমোহিনী ঠ্যাঙাটা বাগিয়ে প্রায় লাফ মেরে খাট থেকে নেমে ভুবনবাবুকে টেনে আনলেন দরজার কাছ থেকে, “তুই ছেলেমানুষ, গিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে থাক। আমি দেখছি, কে আমার বাছার গায়ে হাত দেয়। যা যা, খাটের তলায় যা।”
মায়ের হুকুম। ভুবনবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় সেঁধিয়ে গেলেন। হরমোহিনী ঠ্যাঙা হাতে দরজা আগলে দাঁড়ালেন দেখে মোক্ষদা মূর্ছা গেল।
ডাকাত দৌড়ে আসছিল ঠিকই। কিন্তু বারান্দায় রাখা এক বালতি জলে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে আছাড় খেল।