“অধমের নাম পাঁচু মোদক। এমন সুযোগ আর পাবেন না।”
“কিসের সুযোগ?”
“আজ্ঞে, গণেশের ভূত এই কাছেই ঘাপটি মেরে আছে। আমি বন্ধন মন্ত্র দিয়ে বাছাধনকে একেবারে বেঁধে রেখে এসেছি। তবে কি না…”
“তবে কী?”
“আজ্ঞে আমি গরিব মানুষ, পেটের দায়েই এইসব করতে হয়। তাই বলছিলাম কি….”
“কত দিতে হবে?”
“আজ্ঞে শ-পাঁচেক হলে বেশ হয়। শ-চারেক হলেও মন্দ হয় না। আর দুশো টাকা হলে মন্দের ভাল।”
কে যেন পিছন থেকে একটা হ্যাঁচকা টানে পাঁচুকে সরিয়ে নিয়ে বলল, “আহাম্মক কোথাকার! ওভাবে দর কমাতে হয়?”
.
ভুবনবাবু আর রামলালবাবু মিলে ল্যাবরেটরিটা সারাদিন খেটে ফের সাজিয়ে তুলেছেন। আসল ধকলটা অবশ্য রামলালবাবুর ওপর দিয়েই গেছে, ভুবনবাবু শুধু তদারকি করেছেন। শুধু সাজিয়ে তুলেই রেহাই নেই। কোন্-কোন্ কেমিক্যাল মিলিয়ে মিশিয়ে দুলালবাবু রাত্রিবেলা একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন তাও হিসেব করে করে বের করতে হয়েছে রামলালবাবুকে। এখন তিনি খুবই ক্লান্ত। তবু ছুটি নেই। কারণ, ল্যাবরেটরিতে বসে ভুবনবাবু কাল রাত থেকে এ-পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করছেন। মাঝে-মাঝে রামবাবুর কাছ থেকে তথ্য জেনে নিচ্ছেন।
লিখতে লিখতে মাঝে-মাঝে তিনি ভাবছেনও। গোটা ঘটনাটাই তাঁর কাছে ভীষণ ধোঁয়াটে বলে মনে হচ্ছে।
রামলাল ঢুলছিলেন চেয়ারে বসে। ভুবনবাবু তাঁর দিকে একবার তাচ্ছিল্যের চোখে চেয়ে বললেন, “বুঝলে রামলাল, ব্যাপারটা এখনও কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না…”
“আজ্ঞে না।”
ভুবনবাবু ভ্রূ কুঁচকে ছেলেকে নীরবে একটু ভর্ৎসনা করলেন যেন। তারপর বললেন, “তুমি কি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছ?”
“আজ্ঞে ভাবছি। খুব ভাবছি।”
“তোমার ভাবসাব দেখে তা মনে হচ্ছে না। তোমার তো দেখছি ঘুমও পাচ্ছে। কিন্তু এরকম এটা রহস্যময় রোমহর্ষক ঘটনার পর ঘুম আসা বা খিদে পাওয়া বা হাস্যোদ্রেক হওয়ার কথাই নয়।”
‘আজ্ঞে, তা বটে।”
“ঘুম বেশি পায় গবেটদের।”
“আজ্ঞে বটেই তো।” ভুবনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “যাকগে, এখন বলো তো আমাদের এবার কী করা উচিত?
রামলাল একটা বিকট হাইকে চাপতে গেলেন, দুটো কান দিয়ে বাতাস বেরিয়ে গেল। বললেন, “আমার তো মনে হয় এই ল্যাবরেটরিটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।”
“বলো কী! কেন?”
“আজ্ঞে, এখানে ভূতটুত কিছু আছে, সবটাই ভুতুড়ে কাণ্ড।”
ভুবনবাবু চোখ কপালে তুলে অতিশয় বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “এই বিজ্ঞানের যুগে তুমি ভূতে বিশ্বাস করো, নিজে একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও?”
রামলালবাবু বিনয়ের সঙ্গে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে বললেন, “কিন্তু আপনিই তো ভৌত চশমা আবিষ্কার করেছেন এবং তার ভিতর দিয়ে বিস্তর ভূতও দেখা গেছে। ভূত না থাকলে কি সেটা সম্ভব হত?”
ভুবনবাবু বিপাকে পড়ে একটু আমতা-আমতা করে বললেন, “আমারটা হল সায়েন্টিফিক রিসার্চের ফল, আর তোমাদেরটা হল কুসংস্কার। একটা হল বৈজ্ঞানিক ভূত, আর-একটা হল কল্পনার ভূত।”
রামলালবাবু বিনয় এবং দৃঢ়তার সমান মিশেল দিয়ে বললেন, “বিজ্ঞানে ভূতের কোনও স্থান নেই। সেইজন্যই আপনার ভৌত চশমা নিয়ে লোকের মনে নানারকম সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছে, চশমা দিয়ে যা দেখা যায় তা চোখের ভুল।“
ভুবনবাবু মহা খাপ্পা হয়ে টেবিলে মস্ত একটা থাপ্পড় কষিয়ে বললেন, “কোন্ আহাম্মক এত বড় কথা বলেছে? তার নাম বলো।”
ভুবনবাবুর রুদ্রমূর্তি দেখে রামলাল মিইয়ে গিয়ে বললেন, “কেউ বলেনি এখনও, তবে বলতে পারে।”
“কে এমন কথা বলতে পারে? কার ঘাড়ে দু’টো মাথা গজিয়েছে?”
রামলাল দৃঢ়তা ছেড়ে পুরোটাই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আজ্ঞে, সেরকম লোক নেই বলেই মনে হয়। তবে কিনা, আমিও আগে ভূতে বিশ্বাস করতাম না, আপনার ভৌত চশমাটা আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই ভূতপ্রেতে বেশ বিশ্বাস হয়েছে। এরকম অদ্ভুত আবিষ্কার আর তো কেউ করতে পারেনি।”
এ কথায় ভুবনবাবুর মুখ উজ্জ্বল হল। তিনি খুশি হয়ে বললেন, “তা বটে। তবে হ্যাঁ, ভূতপ্রেত থাকলেও তাতে অত বিশ্বাস রাখতে নেই। আর হ্যাঁ, ল্যাবরেটরিটা বন্ধ করে দেওয়াও মূখের মতো কাজ হবে। আমার মনে হয়, দুলালবাবু যুগান্তকারী একটা কিছু আবিষ্কারের গন্ধ পেয়ে ফেলাতেই তাঁর বিপত্তি হয়েছে। কোনও দুষ্টচক্র আবিষ্কারের গন্ধ পেয়ে তাঁকে গুম করেছে এবং তাঁর জায়গায় তাঁর মতো দেখতে আর-একটা লোককে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। এইসব সম্ভাবনার কথা তোমার মগজে আসছে না কেন?”
“আজ্ঞে আসছে। আমার মগজেও এইসব সম্ভাবনার কথাই আসছে। তবে ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে আর ভুতুড়ে।”
ভুবনবাবু একটা লিস্ট টেনে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, “এই কেমিক্যালগুলোই দুলালবাবু ব্যবহার করেছিলেন, তাঁর আবিষ্কারে। তা তুমি এসব মিশিয়ে দ্যাখো কিছু একটা হয় কি না। হয়তো এর সঙ্গে আরও কিছু ছিল, সেসব তুমি বিচার করে দেখবে। সহজে হাল ছেড়ে দিও না।”
“যে আজ্ঞে।”
ভুবন রায় উঠে পড়লেন। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে।
হরমোহিনীর ঘর পার হয়ে ভুবনবাবুর ঘর। মায়ের ঘরের দরজা পেরনোর। সময় হরমোহিনী হাঁক দিলেন, “কে যায় রে?”
“আমি মা, আমি ভুবন।”
“ভুবন! না বাবা, আমি মুখের কথায় বিশ্বাস করি না। শুনলুম, কাল সারা রাত্তির ধরে এ বাড়িতে চোরের উপদ্রব হয়েছে। দেখি বাবা, তোর মুখোনা আগে দেখি। আজকালকার চোরেরা ভারি সেয়ানা, তারা নানারকম নাম নেয় যখন তখন। আগে মুখ দেখব, তবে বিশ্বাস করব। ও মোক্ষদা, আমার ঠ্যাঙাটা দে তো, হাতে রাখি। আর তুইও ওই মুগুরখানা নিয়ে তৈরি থাক।”