পাঁচু জুলজুল করে দুলালবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “ওরে বাবা, তা হলে তো চিন্তার কথা মশাই।”
“চলো, দুজনে মিলে একটা কিছু করে আসি।”
পাঁচু সভয়ে বলল, “কী করতে চান?”
“একটা হই-হট্টগোল পাকিয়ে দিয়ে আসি শহরে। চলো, চলো….”
“আজ্ঞে আমার বয়স যে সত্তর পেরিয়েছে।”
“তাতে কী? বসে থেকে-থেকেই যে জাতটা শেষ হয়ে গেল। ওঠো, একটা হুটোপাটি করে আসি গিয়ে।”
.
সন্ধে হয়ে গেছে। পোড়ো বাড়ির সামনের দিকে ভৌত ক্লাবের সদস্যরা একে একে জড়ো হয়েছেন। ফটিকবাবু, সাত্যকীবাবু, নরেনবাবু, সবাই আছেন। নন্দবাবুও এসে হাজির হলেন। মড়ার খুলির দু’পাশে মোমবাতি জ্বলছে। বেশ ভৌতিক আবহাওয়া। কিন্তু সকলের মুখেই একটা উদ্বেগের ভাব।
নন্দবাবু বললেন, “দুলালবাবুর মতো চেহারার সেই লোকটার কাণ্ডকারখানা সব শুনেছেন তো?”
সবাই ‘হুঁ’ দিল।
ফটিকবাবু বললেন, “আজ আমাকে লোকটা খুন করার চেষ্টা করেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। তবে টাকাপয়সা সবই ডাকাতি করে নিয়ে গেছেন। ভাবা যায় না।”
একজন বলল, “তবে লোকটা যা ক্রিকেট খেলেছে আজ তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। লারউডও ওরকম খেলতে পারতেন না।”
ক্রিকেটের কথাও সবাই শুনেছে।
নন্দবাবু বলে উঠলেন, “কিন্তু লোকটা কে?”
অল্পবয়সীরা সমস্বরে বলে উঠল, “উনি দুলাল স্যারই হবেন।”
“কিন্তু দুলালবাবুর মতো দেখতে হলেও এঁর যে বয়স কম, জোর বেশি।”
একটি ছোরা মাথা নেড়ে বলল, “কায়কল্প, আর যোগ ব্যায়ামের ফল। দুলালবাবু রিটায়ার করার পর যোগ ব্যায়াম শুরু করেছিলেন। আর তাতেই চেহারাটা একেবারে ছোঁকরা-মাকা হয়ে গেছে।”
সাতকীবাবু বললেন, “শুনেছি, কুমিরের রক্ত খেলে নাকি বয়স কমে যায়?”
“না না, বানরের ঘিলু।”
“ওরে, তোরা কিছুই জানিস না। বয়স কমানোর জন্য দরকার হল বাঘের চর্বি। গায়ে মেখে সাত দিন বসে থাকতে হয়।”
এই নিয়ে একটা তর্ক পাকিয়ে উঠল।
হঠাৎ পোড়া বাড়ির দিককার বন্ধ জানলাটা দড়াম করে খুলে গেল, আর একটা বাতাসের ঝাঁপটায় নিভে গেল মোমবাতি।
ঘুরঘুটি অন্ধকার।
জানালার বাইরে থেকে একটা রক্ত জল করা খোলা হাসির শব্দ এল।
.
পোড়ো বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে ভাঙা পাঁচিলটা ডিঙোবার পর দুলালবাবু পাঁচু মোদককে বললেন, “একটা চেঁচামেচি হচ্ছে যেন!”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে ভুতোবাবুরা মনে হয় ভয়টয় পেয়েছেন।”
“ভুতোবাবু কারা?”
“আজ্ঞে ওই ক’জন বাবু মিলেমিশে একটা ক্লাব করেছেন। ভারি মজার ক্লাব আজ্ঞে। তাঁরা সব ভূত নামানোর জন্য নানা কসরত করেন।”
“ভূত কি নামে?”
“আজ্ঞে এখনও নামেনি। তবে আমি যাতায়াতের পথে মাঝে-মাঝে ঢিল ছুঁড়ে বা ফাঁকা গলায় আওয়াজ তুলে বাবুদের ভয়টয় দেখাই আর কি।”
“তা আজ চেঁচামেচি হচ্ছে কেন?”
চেঁচামেচি বেশ ভালই হচ্ছিল। কে যেন তারস্বরে “রাম, রাম করে চেঁচাচ্ছে! আর-একজন “হরেকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ।”
একজন চেঁচিয়ে বলছে, এইবার…এইবার…জয় ভূত…জয় ভূত… ব্যোম কালী….এবার আমার শালা বাজি হারবেই…।”
আর দরজা খুলে সটাসট দৌড়ে কিছু লোক পালিয়েও গেল।
দুলালবাবু বললেন, “ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে হে পাঁচু।”
পাঁচু বেজার মুখে বলল, “দেখার কিছু নেই। বাবুরা ওরকম মাঝে-মাঝেই করেন। “ভিতুর ডিম সব। এই তো সেদিন নন্দবাবু একখানা হেলমেট ফেলেই পালিয়ে গেলেন। আমি সেখানা যত্ন করে তুলে রেখেছি। কখন কোন কাজে লাগে। বলা তো যায় না।”
দুলালবাবু উৎকর্ণ হয়ে কিছুই শুনছিলেন। বললেন, “উত্তর দিকের জঙ্গলে কে যেন হাসছে, শুনতে পাচ্ছ?”
পাঁচু শুনল, তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, “ও গণেশ।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে গণেশ গন্ধবণিক। এই তো হপ্তাখানেক আগে জঙ্গলের একটা জামগাছে গলায় গামছা দিয়ে ম’ল।”
দুলালবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরেছে?”
“আজ্ঞে একেবারে নির্যস মরাই মরেছে। নিজের চোখে দেখা।”
“তবে হাসছে কী করে?”
“আজ্ঞে সেইটেই তো গোলমেলে। বেঁচে থাকতে গণেশকে কেউ হাসতে দ্যাখেনি। মুখোনা গোমড়া করে ঘুরে বেড়াত। ঘরে দজ্জাল বউ। তা এখন মনের সুখে হাসছে। বেশ ফুর্তিতেই আছে মনে হয়।”
“গণেশ কি তা হলে ভূত হয়ে?”
পাঁচু মাথা চুলকে বলল, “তা না হলে আর হাসে কী করে বলুন। নতুন ভূত হয়েছে তো, এসময়টায় একটু দুষ্টুবুদ্ধি কাজ করে। এই যেমন ছেলেপুলেরা করে আর কি।”
“তুমি ভূত দেখেছ?”
“বিস্তর। রাত-বিরেতেই তো আমার কাজ। নিশুত রাতে কত তেনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।”
“বলো কী?”
পাঁচু খুব বিনয়ের সঙ্গে হেঃ হেঃ করে একটু হাসল। মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “তবে তাঁরা সকলেই কিছু খারাপ লোক নয়। দু’চারজন তো রীতিমত স্নেহই করেন। দেখা হলেই খোঁজখবর নেন।”
“বটে! কিন্তু আমি হচ্ছি বিজ্ঞানের লোক। ভূতটুত মানি না। তবে ভূত যদি দেখাতে পারো, তা হলে মানতে আমার আপত্তি নেই।”
পাঁচু বেজার মুখ করে বলল, “আপনাকে ভূত দেখিয়ে আমার কাজ কী? ভূত আপনি মানুন বা না মানুন তাতে আমার কচুপোড়া। তার চেয়ে ভূত-পাগলা ফটিকবাবুকে দেখাতে পারলে একটা কাজ” হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আজ্ঞে ফটিকবাবু, একটু গুরুতর কথা ছিল। এমন সুযোগ আর হবে না।”
ভৌত ক্লাবের ভিতরে তখন তিনজন মূর্ছা গেছেন, দু’জন হতভম্ব, ফটিকবাবু শুধু ছটফট করছেন আর বলছেন, কোথায় ভূত? কোথায় ভূত?”
পাঁচুর কথা শুনে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “তুমি কে?”