সাবেক দুলাল আর নতুন দুলালের মধ্যে খটাখটিটা এখনও চলছে। সাবেক দুলাল বলছে, “না হে, না বলে কয়ে অন্যে বিছানাটা দখল করা ঠিক কাজ হল না।”
নতুন দুলাল, নাক সিঁটকে বলল, “তা হলে মেঝেতে পড়ে থাকাই বোধহয় তোমার মতে ভাল কাজ ছিল?”
‘দ্যাখো দুলাল, তোমার বড় বাড় বেড়েছে। অতি বাড় ভাল নয় জানো তো!”
“তোমার মতো শুটকো দুর্বল লোকেরাই যত নীতিবাগীশ হয়। ভিতুদের তো নীতিই সম্বল। যার জোর আছে সে ওসব পরোয়া-টরোয়া করে না।”
দুলালবাবু ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে ঝগড়াটা অনুধাবন আর উপভোগ করছিলেন। বেশ লাগছে।
একটু বাদেই দুলালবাবুর বেশ নিদ্রাবেশ হল। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। হ্যাপা তো কিছু কম যায়নি।
ঘুম ভাঙল একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। চেয়ে দেখলেন, সামনে নরহরি দাঁড়িয়ে। মুখে সেই বিগলিত হাসি নেই। একটু শুকনোও দেখাচ্ছে।
“এই যে নরহরি!”
“পেন্নাম হই পাঁচুবাবু।”
“তা খবর-কবর সব ভাল তো নরহরি!”
পাঁচু মোদক ওরফে নরহরি বলল, “সকলের খবর কি একসঙ্গে ভাল হতে পারে পাঁচুবাবু? কথায় বলে, কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ।”
“তা বটে। তরে তোমার কোষ্টা?”
“আজ্ঞে আমার সাড়ে সর্বনাশ।”
“‘তার মানে?”
“আপনার জন্য কাল রাত থেকে কী হয়রানিটাই গেল। জীবনে যা কখনও হয়নি তাও আজ হয়ে গেছে। আমি চোর-দায়ে গেরস্তবাড়িতে ধরা পড়েছিলুম। লজ্জায় আর মুখ দেখানোর জো নেই। তারা খুনের দায়ে ফেলবেন, না চুরির দায়ে, তা ঠিক করতে পারছিলেন না।”
“বটে! ভারি মজা তো!”
“মজা আপনার, আমার নয়।”
“ওই হল। আমার মজা হলে তোমারই বা হতে বাধা কী?”
“আছে। বাধা আছে। আপনার হাসি হাসি মুখ আর চকচকে চেহারা দেখে মালুম হচ্ছে বেশ সাঁটিয়ে খেয়েছেন।”
“তা বলতে পারো। সাঁটনটা আজ মন্দ হয়নি। সকাল থেকে বেশ ভালই হচ্ছে।”
“বাজে কথা বলবেন না পাঁচুবাবু, সকাল থেকে নয়, রাত থেকেই আপনার সাঁটন চলছে।”
“রাতের কথাটা মনে ছিল না। কিন্তু খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছ কেন বলো তো! না হয় খোরাকটা একটু বেড়েছেই।”
“আজ্ঞে খোরাক তো আমারও বড় কম নয়। কিন্তু আজ সারা দিনে কী জুটছে জানেন? রায়বাড়িতে ছ’খানা রুটি। মাত্র ছ’খানা।”
“তা হলে তো খুবই অসুবিধে তোমার।”
“আজ্ঞে। তার ওপর চারিদিকে পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনাকে আর আপনার লাশকে খুঁজতে। সঙ্গে আমাকেও। তা হলেই বুঝুন, সর্বনাশ আর কাকে বলে। মেলা চোরাগোপ্তা পথ আর গলখুঁজি জাঙ্গাল-পাঙ্গাল ডিঙিয়ে নিজের ডেরায় এসে দেখছি কী দেখছি, না পাঁচুবাবু ভুড়িটি ভাসিয়ে আমার বিছানা দখল করে পড়ে ঘুমোচ্ছন। বুঝুন তা হলে, পৌষমাস ছাড়া একে আর কী বলা যায়।”
দুলালবাবু ভূ একটু কুঁচকে বললেন, “ওহে শোনো, আমাকে তোমার আর পাঁচু নামে ডাকতে হবে না। নিজের নামটা আমার মনে পড়ে গেছে।”
পাঁচু মুখটা বিকৃত করে বলল, “তবে আর কী, কৃতার্থ করেছেন! এবার নাম বিক্রির টাকাটাও বোধহয় ফেরত চাইবেন!”
দুলালবাবু অমায়িক হেসে বললেন, “পুরোটা দিতে হবে না। এক টাকা নামের ভাড়া বাবদ কেটে চারটে টাকাই না-হয় দাও। এক রাত্তিরের ভাড়া হিসেবে এক টাকা কিছু কমও নয় কী বলো!”
“চাইছেন তা হলে!”
“চাইছি। আজকাল আমার বড় কথায় কথায় খিদে পায়।”
পাঁচু মুখোনা গোমড়া করে ট্যাঁক থেকে পাঁচটা টাকা বের করে বলল, “এই নিন, পুরোটাই ফেরত দিচ্ছি। ভাড়া লাগবে না। দয়া করে বিছানাটা ছাড়েন তা হলে উপোসী শরীরটাকে একটু জিরেন দিতে পারি।”
দুলালবাবু তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, “আহা, শোও হে শোও। আমার যথেষ্ট ঘুম হয়েছে।”
দুলালবাবু উঠে পড়লেন। শরীটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। মনেও বেশ ফুর্তি। গুনগুন করে গান ভাঁজতে-ভাঁজতে ঘরেই পায়চারি করতে লাগলেন।
“আচ্ছা নরহরি?”
“আবার নরহরি কেন? নামটা তো ফেরত দিলেন।”
“তা বটে। আচ্ছা পাঁচু।”
“বলুন দুলালবাবু।”
“এসব কী হচ্ছে বলে তো?”
“কোন্ সব?”
“এই যে, যা সব হচ্ছে, একি ভাল হচ্ছে?”
পাঁচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনার পক্ষে তো বেশ ভালই হচ্ছে দেখছি মশাই। তবে সকলের ভাল তো একসঙ্গে হতে পারে না। ভগবান মানুষটাই এমনি, একজনের পিঠে যখন হাত বোলান তখন আর একজনকে তাঁর চিমটি না কাটলেই নয়। আপনার যেমন ভাল হচ্ছে ওদিকে তেমনি আমার হেনস্থা। ফলে রাতে ওই মোটে কয়েকখানা বাসন তাও রায়মশাই কেড়েকুড়ে নিয়ে নিলেন। তারপর সারাদিন উপোসী পেটে ছোটাছুটি করে দম একেবারে শেষ। তা হোক, আপনার তত ভাল হচ্ছে।”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “ভাল হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। এত ভাল, ভাল নয়। আজ দুটো লোককে এমন ঢিট করলুম যে, বাবা রে মা রে বলে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল। জীবনে আমি কখনও কারও সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠিনি। তা হলে জোরটা এল কোত্থেকে? তারপর খাওয়া। আমি যা খাই বিশ গুণেরও বেশি খেয়ে ফেলেছি, অথচ পেটে খিদেটা কেমন যেন খাচচি মেরে রয়েই গেছে। এই দ্যাখো, বলতে বলতেই আবার খিদে পেয়ে গেল। না হে পাঁচু, এত ভাল, ভাল নয়।”
পাঁচু চোখ বুজে পড়ে ছিল, স্তিমিত গলায় বলল, আপনার ভাবসাব আমারও ভাল ঠেকছে না। রাত্রিবেলা চুরি শেখালুম, একটি পয়সা গুরুদক্ষিণা বলে ঠেকালেন। চুরির মাল ফেরত দিতে হল। নাঃ, আমার সময়টাই খারাপ পড়েছে…
দুলালবাবু পায়চারি করতে করতে বললেন, “আমার খুব মারপিট, দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হচ্ছে। লাফাতে ইচ্ছে করছে। কী করি বলো তো?”