সন্দিহান হয়ে নন্দবাবু হেলমেটটা খুললেন। এবং অবাক হয়ে বুঝতে পারলেন বা বুঝতে পেরে অবাক হলেন যে, দুনিয়ার প্রযুক্তিবিদ্যা অনেক এগিয়ে গেছে। এই হেলমেটটায় টেপরেকর্ডার লাগানো আছে। মাথায় বেল পড়ায় ঝড়াক করে টেপরেকর্ডার চালু হয়ে গান বেরিয়ে আসছে।
নন্দবাবু গানটা বন্ধ করার চাবি খুঁজে পেলেন না। গানসুদ্ধ হেলমেটটা ফের পরে নিয়ে ভুতুড়ে ক্লাবের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কানে গান বাজতেই লাগল।
ভৌত ক্লাবটা একটা ভারি জব্বর জায়গায়। মিত্তিরবাবুদের পোড়ো বাড়ির একাংশে একখানা ঘর আছে। চারদিকে আগাছার জঙ্গল। দিনে-দুপুরেও মানুষ আসে না। সন্ধের পর শুধু শেয়ালেরা ঘোরাঘুরি করে। কৃষ্ণপক্ষে জায়গাটা এত ঘুরঘুট্টি অন্ধকার থাকে যে, নিজের হাতখানা অবধি ঠাহর হয় না।
নোনাধরা দেওয়াল, আধভাঙা দরজা-জানলা, সোঁদা গন্ধ মিলে-মিশে বেশ একটা ভূত-ভূত ভাব। ঘরে একখানা কাঠের টেবিলের ওপর মড়ার খুলি আর পাশে একখানা মোমবাতি জ্বলছে। কয়েকখানা কাঠের চেয়ারে ভৌত ক্লাবের সদস্যরা বসে আছেন। তাদের বয়স ত্রিশ থেকে শুরু করে আশি অবধি। শীতকাল বলে সকলেই একটু মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মুড়ি আর গরমাগরম বেগুনি এসে গেছে। দলের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য গিরিজা একটা কেরোসিন-স্টোভে চা তৈরি করছে। আড্ডা জমজমাট।
এমন সময়ে মাথায় হেলমেট আর হাতে পাকা বেল নিয়ে নন্দবাবু ঘরে ঢুকতেই একটা হইচই গেল।
ফটিকবাবুর ভূত-তৃষ্ণা বা ভূত-ক্ষুধা আজকাল এত বেড়েছে যে, তিনি আজকাল সর্ষের মধ্যেও ভূত দেখার চেষ্টা করেন। নন্দবাবুকে দেখে তিনিই প্রথম সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই তো, এতদিনে বুঝি মা কালী মুখ তুলে চাইলেন…”
রাধাগোবিন্দবাবুর ভয় অন্যরকম। কিছুদিন আগে তিনি সাইকেলে চেপে যাওয়ার সময় রাস্তায় একটা গোরুকে ধাক্কা দেন। তাতে একজন পুলিশম্যান এসে তাঁকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। রাধাগোবিন্দবাবুর প্রতিশোধস্পৃহা সাঙ্ঘাতিক। দু’একদিন বাদেই এক দুপুরবেলা বটগাছের বাঁধানো চাতালে সেই পুলিশম্যানটাকে বসে বসে ঘুমোতে দেখে রাধাগোবিন্দবাবু তার টুপিটা তুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছিলেন। অবিমৃষ্যকারিতা আর কাকে বলে! পুলিশ হল স্বয়ং সরকারবাহাদুরের জবরদস্ত প্রতিনিধি। পুলিশের টুপি চুরি করা যে সাঙ্ঘাতিক অপরাধ তা তিনি পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু টুপিটা গিয়ে ফেরত দিয়ে আসার সাহস আর তার হয়নি। পুলিশকে তার ভীষণ ভয় করে আজকাল। সর্বদাই তিনি আশঙ্কা করছেন, কখন এসে পুলিশ তার ওপর চড়াও হবে।
নন্দবাবুকে দেখে রাধাগোবিন্দবাবু তাই তারস্বরে বলে উঠলেন, “আমি চোর না বাবা, আমি চোর না। মা কালীর দিব্যি, টুপিটা বাতাসে উড়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, আমি ঝেড়েঝুড়ে তুলে রেখেছি যত্ন করে…”
সাত্যকিবাবু খুব ভাল করেই জানেন যে, ভিন গ্রহ থেকে অজানা সব জীব কিভূত সব মহাকাশযানে করে প্রায়ই পৃথিবীতে চলে আসে। খবরের কাগজে প্রায়ই উফো’র খবর থাকে। নন্দবাবুকে দেখে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে, এ হল সেই প্রাণীদেরই একজন। তিনি আঁ-আঁ করে দু’বার দুটো দুর্বোধ্য শব্দ করে উঠলেন। তার মনে হল, ভিন গ্রহের জীব তো সাদামাঠা বাংলা ভাষা বুঝতে পারবে না, তবে সংস্কৃত দেবভাষা, সেটা বুঝলেও বুঝতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতে তিনি বেজায় কাঁচা। সুতরাং যা মনে পড়ল, তাই চেঁচিয়ে বলে যেতে লাগলেন, “ভো ভো আগন্তুকঃ অহং সাত্যকি চট্টরাজ্য। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িস্যামি মা শুচঃ। রক্ষ মাম। নরঃ নরৌ নরাঃ।”
শ্যামবাবু ভালমন্দ কিছু না বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আলোয়ান, সোয়েটার, জামা আর গেঞ্জির ভিতর হাতড়ে পৈতে খুঁজে বারে করে কাঁপতে কাঁপতে গায়ত্ৰীমন্ত্র বেশ চেঁচিয়েই জপ করতে লাগলেন।
হারানবাবুর বয়স আশির ওপর। চোখে ভাল ঠাহর পান না। কিন্তু একটা বিটকেল কিছু যে ঘরে ঢুকেছে, তা আঁচ করে সে-ই যে চোখ বুজে ফেলেছেন, আর চোখ খোলার নাম নেই। চোখ বুজে হুঁহুঁ করে মৃদু মৃদু আওয়াজ ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগলেন, “ই, এর মতো ওষুধ নেই হে বাছাধন। ভূত হও, প্রেত হও, রাক্ষস হও, যমদূত হও, চোখটি বুজে ফেললে আর ভয়টি দেখাতে পারবে না।”
কে একজন ‘পুলিশ, পুলিশ’ বলে চেঁচাচ্ছিল। আর-একজন রামনাম করতে গিয়ে কাশতে লাগল। একজন চেয়ার উলটে পড়ে গেল।
গিরিজা প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেলেও ততটা ঘাবড়ে যায়নি। সে বলে উঠল, “আচ্ছা, সবাই মিলে যে কী পাগলের কাণ্ড বাধালেন? লোকটা কে আগে দেখুন।”
নন্দবাবু এতটা প্রতিক্রিয়া আশা করেননি। তবে তিনি এতে খুশিই হলেন। বহুঁকাল ভারি সাদামাঠা জীবনযাপন করেছেন। তাকে কেউ ভয় খায় না, সমীহ করে না, বাড়ির চাকর বাকরেরা পর্যন্ত তেমন খাতির দেখায় না তাঁকে। আজ তাকে দেখে যে সকলে একেবারে চমকে উঠে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, এতে নিজের ওপর তার একটা বিশ্বাস এসে গেল।
নন্দবাবু গম্ভীর মুখে মড়ার খুলিটার পাশে পাকা বেলটা রেখে হেলমেট খুললেন। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে ফটিকবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি নাকি এখনও ভূত দ্যাখেননি?”
ফটিকবাবু নন্দবাবুর দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, “না, দেখিনি। আপনার মতো বেরসিকও জীবনে দেখিনি। ভাবলাম মা কালী বুঝি আজ মুখ তুলে চাইলেন। তা নয়, ভূতের বদলে নন্দবাবু। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, জীবনটায় ঘেন্না ধরে গেল।”