দুলালবাবু অভিজ্ঞতার বলে সেয়ানা হয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন যে, নিজেকে আর দুলালবাবু বলে চালানোর চেষ্টা বৃথা। তাই তিনি কথাটা স্বীকার করে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। দাদার সঙ্গে আমার চেহারার বড্ড মিল বলে সকলেই ভুল করে।”
“আপনার নাম কী?” দুলালবাবু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “নামে কীই বা আসে যায়! পাঁচু মোদক নামটা কেমন?”
সবাই অবাক হয়ে বলল, “দুলাল সেনের ভাই পাঁচু মোদক হয় কী করে?”
“হয় না বুঝি! তা হলে সুলাল সেন নামটাই চলুক।”
সবাই একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দুলাল সেনের ভাইয়ের মাথায় একটু ছিট আছে কি? তবে থাকলেও ক্ষতি নেই। লোকটা খেলে ভাল।
দুলালবাবুর নাম ক্লাবের খাতায় সুলাল সেন বলেই লেখা হল।
দুপুরবেলা জয়ন্ত সোম নিজের গাড়িতে করে মহা সমাদরে দুলালবাবুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বিশাল আয়োজন হয়েছে খাওয়ার। স্নান করে বেশ চা বোধ করলেন দুলালবাবু, খিদেটাও চাগিয়ে উঠল। খেতে বসবার কিছুক্ষণ পর নিজের খাওয়া দেখে দুলালবাবুর নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। আসলে লজ্জা পাচ্ছিল তাঁর ভিতরকার সাবেক দুলাল। নতুন দুলাল ওসবের তোয়াক্কা করে না, সে আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে-মেড়ে শুধু খেয়েই চলে। পাহাড়-পর্বত খেয়ে ফেলতে চায়।
সাবেক দুলাল বলে, “আস্তে হে দুলাল, আস্তে। অতটা মাংস না-ই বা খেলে! ঘি, গরমমশলা, লঙ্কাবাটা কি রোগা পেটে সইবে!”
নতুন দুলাল খেঁকিয়ে উঠে বলে, “নজর দেবে তো মারব দুই থাবড়া। নিজে খেতে পারতে না বলে এখন হিংসে হচ্ছে, না?”
সাবেক দুলাল দুঃখের গলায় বলে, “না ভাই, হিংসে নয়। তোমার জন্য বরং দুশ্চিন্তাই হচ্ছে। ওই যে সাতখানা কই মাছ ওড়ানোর পর ফের মাছ চাইলে, তোমার লজ্জা করল না? ভদ্রলোকেরা কি অত খায়? আর গেরস্তর দিকটাও
তো ভাববে! তাদেরও তো কম পড়ে যেতে পারে।”
“দ্যাখো হে সুটকো দুলাল, তুমি একটি আস্ত শনিঠাকুর। সর্বদা টিক টিক করো বলেই তোমার উন্নতি নেই। কিন্তু এখন আমার মাথা গরম কোরো না। খাওয়ার সময় দিক করলে আমার মাথার ঠিক থাকে না।”
দুলালবাবু মোট ষোলোটা কই মাছ, সেরটাক মাংস, জামবাটি-ভর্তি পায়েস ও অন্যান্য উপকরণ শেষ করে যখন উঠলেন, তখন বাস্তবিকই জয়ন্ত সোমের ভিতর বাড়িতে ভাঁড়ার ফাঁকা। নতুন করে রান্না চাপাতে হয়েছে।
দুলালবাবু নিজের পেটে আবার একটু তেরে-কেটে-তাক বাজিয়ে নিলেন। না, মোটামুটি ভরেছে বলেই মনে হচ্ছে।
খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিতে যাবেন, এমন সময় সদর দরজায় কড়াতকড়াত করে কড়া নাড়ার শব্দ হল। বেশ জোরালো আর মেজাজি আওয়াজ।
জয়ন্ত সোম দরজা খুলতেই পুলিশের দারোগার অত্যন্ত গম্ভীর মুখ দেখা গেল। তিনি গুরুতর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “দুলাল সেন এখানে আছে বলে আমরা খবর পেয়েছি।”
জয়ন্ত সোম উৎকণ্ঠ হয়ে বললেন, “আজ্ঞে না, তবে তাঁর ভাই …”।
দারোগা বাধা দিয়ে বললেন, “লোকটা যে দুলাল সেন নয় তা আমরাক্টজামি। লোকটা আসলে খুনি। ইমপস্টার। কখনও নিজের নাম বলছে পাঁচু মোদক, কখনও দুলাল সেন…”।
“অ্যাঁ!” বলে হাঁ করে রইলেন জয়ন্ত সোম।
“হল কী মশাই? হাঁ করে রইলেন কেন?”
জয়ন্ত আমতা-আমতা করে বললেন, “আমাদের কাছেও যে তাই বলেছে। নতুন একটা নামও বলেছে। সুলাল সেন।”
“কই, চলুন, চলুন লোকটাকে এক্ষুণি গ্রেফতার করতে হবে। সাঙ্ঘাতিক খুনি। দুলাল সেনকে মেরে পুঁতে ফেলেছে…..”
দারোগা-পুলিশ সব হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর চারদিকে তুমুল তল্লাশি হতে লাগল। কিন্তু কোথাও দুলাল সেনকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
দুলাল সেনের দোষ নেই। পুলিশ এসেছে টের পেয়েই তিনি জানালা গলিয়ে ঘরের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে দৌড়োতে লেগেছেন। যদিও তিনি জানেন যে, নিজেকে খুন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তবু আপাতত গা-ঢাকা দিতেই হচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে দুলাল সেন যে-জায়গাটায় এসে থামলেন, সেটা ভৌত-ক্লাবের পিছনের পোডড়া বাড়ি। জায়গাটা এক নজরেই তাঁর পছন্দ হয়ে গেল। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, আগাছার দুর্ভেদ্য বেড়া। এখানে চট করে ঢুকতে কেউ সাহস পাবে না।
দুলালবাবু গুঁড়ি মেরে কাঁটাঝোঁপের জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে পড়লেন একটা দেওয়ালের কানায়। তারপর পাঁচ ফুট নীচে লাফ দিয়ে নেমে একটা ঢিবি পেরোলেন। আরও গলিখুঁজি এবং ভুলভুলাইয়া পার হয়ে ভিতরে ঢুকে বেশ একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরে এসে ঢুকলেন।
ঘরখানা দেখে খুবই অবাক। এমন একখানা পোড়ো এবং ভাঙা বাড়ির মধ্যে এই ঘরখানা যেন হাসছে। দিব্যি ঘর। রোজ ঝাঁটপাট হয় বলে মনে হচ্ছে। একধারে একখানা তক্তাপোশ, তার ওপর শতরঞ্চি আর চাঁদর পাতা। একখানা বালিশ আর ভাঁজ করা কম্বল। আর আছে জলের কুঁজো। ঘরের কোণে একটা কুলুঙ্গি তে কিছু অদ্ভুত ধরনের যন্ত্রপাতি। ঘুরে-ঘুরে সবটাই দেখে নিলেন দুলালবাবু। এ-ঘরে কেউ থাকে!
যে থাকে থাকুক, আসল কথা হচ্ছে লোক্টা এখন নেই। সুতরাং তার বিছানাটা দখল করতে কোনও আপত্তি ওঠার কথাও নেই। দুলালবাবুর মধ্যাহ্নভোজন ভালই হয়েছে। এখন চোখ বুজে বিশ্রাম করা দরকার। পুলিশ তাঁকে এই পোড়া বাড়ির ভিতরে খুঁজতে আসবে না, এ-বিষয়ে তিনি নিশ্চিন্ত।
দুলালবাবু বিছানায় শুয়ে গায়ে কম্বলটা টেনে নিলেন। তারপর চোখ বুজে কাল রাত থেকে আজকের এই অবধি ঘটনাটা ভাবতে লাগলেন।