নবীন ময়রার হঠাৎ দয়া হল। বলল, “মাস্টারমশাই, আপনি যে কচুরি ভালবাসেন তা তো জানতাম না। আচ্ছা, আপনি বসুন, পেট ভরে যা খুশি খান, আজ আপনাকে দাম দিতে হবে না। আপনার চেষ্টাতেই না গবেট ছেলে রেমো পাশ করতে পেরেছিল। ওরে, মাস্টারমশাইকে আরও দে!”
দুলালবাবু ফের বসে গেলেন এবং তারপর যা খেতে লাগলেন, সে-একটা দৃশ্যই বটে। স্বয়ং নবীন আর তার কর্মচারীরা দুলালবাবুর খাওয়া দেখে এমন বিহ্বল হয়ে গেল যে, কাকে এসে জিলিপি তুলে নিয়ে গেল, বেড়াল এসে দুধ খেয়ে যেতে লাগল, কড়াইতে কচুরি পুড়ে ঝামা হয়ে গেল।
নবীন ময়রা দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “সাক্ষাৎ বৃকোদরের দেখা পেলাম আজ। চক্ষু সার্থক, ময়রাজন্মও সার্থক। ওরে মাস্টারমশাইকে আরও দে, হাঁ করে দেখছিস কী?”
তা দুলালবাবুর তাতে আপত্তি হল না। এক ঝুড়ি কচুরি আর এক বারকোশ হালুয়া খেয়ে ডজন-চারেক জিলিপি আর সেরটাক রাবড়ি চালিয়ে দিলেন ভিতরে। তারপর ঠেলে-ওঠা পেটটার ওপর একটু তেরে-কেটে-তাক বাজিয়ে নিয়ে বললেন, “না, এতেই দুপুর পর্যন্ত চলে যাবে।”
খেয়েদেয়ে মনটা বেশ প্রসন্ন লাগল দুলালবাবুর, হাসিমুখেই বেরিয়ে পড়লেন। শরীরটা চনমন করছে একটা কিছু করার জন্য। দৌড়তে ইচ্ছে করছে, লাফাতে ইচ্ছে করছে, ছুঁড়তে হচ্ছে করছে।
দুলালবাবু খানিকদূর হেঁটে যেতেই দেখতে পেলেন বি.এন. ক্লাবের মাঠে খুব জম্পেশ করে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। বি.এন. মানে বিবেকানন্দ ক্লাব। এই অঞ্চলে বিবেকানন্দ ক্লাবের খুব নামডাক। তারা জেলার শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট টিম। বাঘা-বাঘা সব বোলার আর ব্যাটসম্যান খেলে। বাঘা সেন আর বিক্রম সিংহ দুই সাঙ্ঘাতিক ফাস্ট বোলার। তেজেশ বাগ আর সূর্যজিৎ পালধি বিখ্যাত ব্যাটসম্যান। তারাই সব খেলছে।
দুলালবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খেলা দেখলেন। তাঁর মনে হল বাঘা সেন-এর বল মোটেই তেমন জোরালো নয়। বিক্রম সিংহও নিতান্তই ম্যান্তামারা।
ধুতিটা একটু গুটিয়ে পরে নিলেন দুলালবাবু। তারপর সোজা মাঠের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
“এই যে বাঘা, ও কী বল করছ ভাই? এই কি হাতের জোর? দাও তো। দেখি আমাকে একবার।”
বাঘা সেন দুলালবাবুর প্রাক্তন ছাত্র। মাস্টারমশাইকে সে ভালই চেনে। জীবনে খেলাধুলার ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি দুলালবাবু। তাই সে অবাক হয়ে বলল, “স্যার, আপনি বল করবেন?”
দুলালবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, “আরে দ্যাখোই না, কীরকম করি।”
বাঘা তাড়াতাড়ি বলটা দুলালবাবুর হাতে দিল। দুলালবাবু বল করার কায়দাটা খানিকক্ষণ দেখে মনে মনে রপ্ত করে নিয়েছেন। অনেকটা দৌড়ে এসে তিনি বলটা হাত ঘুরিয়ে চমৎকার ছেড়ে দিলেন।
ব্যাট করছিল বিখ্যাত সূর্যজিৎ। বলটা পিচে পড়েই এমন অদৃশ্য হয়ে গেল যে, সূর্যজিৎ ব্যাট হাতে হাঁ করে রইল। ততক্ষণে অবশ্য বলটা তার লেগ আর মিডল স্টাম্প উপড়ে দিয়ে বাউন্ডারিতে চলে গেছে।
চারধারে নিস্তব্ধতা নেমে এল বিস্ময়ের। তারপরেই অবশ্য সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।
সূর্যজিৎও দুলালবাবুর পুরনো ছাত্র। সে এগিয়ে এসে বলল, “স্যার, আপনার ভিতরে যে এত বড় একজন ফাস্ট বোলার লুকিয়ে ছিল, তা তো কখনও টের পাইনি।”
দুলালবাবু একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “ক্রমে ক্রমে আরও কত কী টের পাবে!”
মাত্র চার ওভারের মধ্যেই দুলালবাবু দশজনকে আউট করে দিলেন। চারদিকে একটা হইচই পড়ে গেল। বি.এন. ক্লাবের সেক্রেটারি স্বয়ং এসে বললে ‘দুলালবাবু আপনি আমাদের ক্লাবে জয়েন করুন।”
দুলালবাবু মিটমিট করে হেসে বললেন, “আমাকে রিক্রুট করা বড় চাট্টিখানি কথা নয়। আমার খোরাক কে দেবে?”
“সে আর বেশি কথা কী? আমার বাড়িতেই খাবেন।”
“বটে! পারবেন তো খাওয়াতে?”
সেক্রেটারি জয়ন্ত সোম মস্ত বড়লোক। টাকাপয়সার অভাব নেই। তাঁর আত্মসম্মানে লাগল। বললেন, “পারব না মানে? কত আর খাবেন আপনি?”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। ভেবে বলব।”
“এর আর ভাবাভাবির কী আছে? আগামীকালই আমাদের সঙ্গে রসুলপুরের রামকৃষ্ণ ক্লাবের খেলা। আর, কে, ক্লাব খুবই ভাল টিম। আপনাকে এ-খেলায় নামতেই হবে।”
দুলালবাবু নিমরাজি হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, দেখব।”
জয়ন্ত নোম বললেন, “আর আজ দুপুরে আমার ওখানেই চাট্টি খাবেন।”
দুলালবাবু একটু তেরিয়া হয়ে বললেন, “চাট্টি মানে? ওসব চাট্টি-ফাট্টিতে আমার আজকাল হয় না বাপু। আর খেতে বসলে লজ্জা-উজ্জার বালাইও থাকেনা।”
জয়ন্ত নোম একটু লাল হয়ে বললেন, “ঠিক আছে। লজ্জা করার মতো ব্যবস্থা হবে না, ভাল করেই খাওয়াব।”
দুলালবাবুকে এরপর ব্যাটও করতে হল। কিন্তু সেটায় তেমন জুত করতে পারলেন না। তবে আনতাবড়ি ব্যাট চালিয়ে যে কটা লাগাতে পারলেন সব ক’টাই ছক্কা হওয়ায় গোটা-ষাটেক রান তুলে আউট হয়ে গেলেন।
দুলালবাবুর অসামান্য ক্রীড়াপ্রতিভা এতকাল কোথায় লুকানো ছিল, তা সবাই জানতে বিশেষ আগ্রহী। খেলার পর সবাই দুলালবাবুকে ঘিরে ধরল।
আর তখনই সেই দুলালবাবুর সঙ্গে এই দুলালবাবুর নানা খুঁটিনাটি পার্থক্য সকলের চোখে পড়তে লাগল। সেই দুলালবাবু ছিলেন রোগা, সুটকো, দুবলা, আর এই দুলালবাবু ছিপছিপে হলেও তাগড়াই, লড়াকু, জোরদার। বয়সটাও বেশ তফাত।
সূর্যজিৎ আমতা-আমতা করে বলল, “কিছু মনে করবেন না, আপনি কি দুলালবাবুর ছোট ভাই?”