নতুন দুলাল জবাবে বলে উঠল, “রাখো, রাখো, তোমার ভালমানুষি। এই হালদার তোমার অভাবের সময় নিজের গবেট ছেলেকে চার মাস পড়িয়ে নিয়ে মাত্র এগারো টাকা ঠেকিয়েছিল, তা মনে আছে হে!”
“আহা, তাতে কী! বিদ্যাদান মহা পুণ্যকর্ম। টাকা-পয়সা কিছু নয়।”
“নয় মানে? টাকা-পয়সা কিছু নয় বললেই হল? এখন পকেটে গোটা-দশেক টাকা থাকলে নবীন ময়রার দোকানে বসে গরম-গরম কচুরি আর হালুয়া খাওয়া যেত না?”
এদিকে চালে ঢিল পড়ায় খিটকেল হালদারবাবু রে-রে করে তেড়ে বেরিয়ে এলেন। এসে দুলালবাবুকে দেখে তাজ্জব। আমতা-আমতা করে বললেন, “দুলালবাবু যে! তা ঢিলটা কে মারল দেখেছেন নাকি?”
দুলালবাবু বুকটা একটু চিতিয়ে বললেন, “আমিই মেরেছি। আপনি লোকটা খুবই খারাপ। ভীষণ রকমের খারাপ।”
হালদার চোখ পাকিয়ে বললেন, “বটে! কে বলল আমি খারাপ?”
“আমিই বলছি।”
“আপনার তো খুব তেল হয়েছে দেখছি!”
“মুখ সামলে কথা কইবেন।”
“বটে! না হলে কী করবেন শুনি!”
দুলালবাবু আর একটা ইট তুলে নিলেন। তাঁর বিবেক বলল বটে যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, তবু ধাঁই করে সেটাও টিনের চালে মারলেন তিনি।
হালদারবাবু এক লাফে এসে দুলালবাবুর টুটি টিপে ধরলেন। কিন্তু নতুন দুলালের সঙ্গে পারবেন কেন? দুলালবাবু এক ঘুসিতে তাঁকে সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলে হাঃহাঃ করে হেসে উঠলেন।
ওদিকে হালদারের ছেলে শিবু বেরিয়ে এসে বাপের হেনস্তা দেখে আর থাকতে পারল না। সে মহা গুণ্ডা প্রকৃতির। ছুটে এসে সে দুলালবাবুকে জাপটে ধরে বলল, “স্যার, আপনাকে আমি মারব না, শত হলেও মাস্টারমশাই, কিন্তু পুলিশের হাতে তুলে দেব।”
দুলালবাবু ফের অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে শিবুকে স্রেফ বেড়ালছানার মতো তুলে দূরে ছুঁড়ে দিলেন।
এই কাণ্ড দেখে চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসতে লাগল। দুলালবাবু আর দাঁড়ালেন না। তাড়াতাড়ি অন্য রাস্তায় ঢুকে ছুটতে ছুটতে ভিন পাড়ায় চলে এলেন। তাঁর বেশ ফুর্তি লাগছিল। নাঃ, এতদিনে বেঁচে থাকাটাকে প্রথম উপভোগ করা যাচ্ছে।
এই পাড়াতে ফটিকবাবুর বাস। ফটিকবাবুর সঙ্গে একসময়ে খুব দহরম-মহরম ছিল। সেই সময় একদিন ফটিক তাঁর কাছ থেকে দশটা টাকা ধার নিয়েছিল। এতকাল ঘটনাটা খেয়াল ছিল না দুলালবাবুর। এখন স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়ে ওঠায় মনে পড়ে গেল।
তিনি সোজা গিয়ে ফটিকের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে হেঁড়ে গলায় ডাকলেন, “ফটিক! ফটিক!”
ফটিকবাবু ঘুম থেকে উঠলেও ভাল করে ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গতকাল রাতে ভূতের খোঁজে মহানন্দ কাঁপালিকের ডেরায় রাত তিনটে অবধি ধরনা দিয়ে বসে ছিলেন। ভূত দেখতে পাননি। তাই মেজাজটাও খিচড়ে আছে। তাঁর শালা খুব ঠেস দিয়ে কথা বলছে আজকাল। বাজিটা একরকম হেরেই গেছেন বলা যায়।
দুলাল সেনকে দেখে তিনি বিশেষ আহ্লাদিত হলেন না। হাই তুলে বললেন, “দুলালদা যে! এত সকালে কী মনে করে?”
“বছর-পাঁচেক আগে তুমি দশটা টাকা ধার নিয়ে আর শোধ দাওনি। আমি এখন গরম কচুরি খেতে যাচ্ছি, বড্ড খিদে পেয়েছে। দশটা টাকা দাও।”
ফটিকবাবু একটু কৃপণ লোক। চোখ কপালে তুলে বললেন, “দশটা টাকা! ধার! এসব কী বলছ দুলালদা? আমার তো মনে নেই!”
“চোপ, দুলাল সেন একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বললেন, “তোমার মনে না থাকলেও আমার আছে। টাকাটা দাও শিগগির।
ফটিকবাবু কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে খানিকক্ষণ দুলালবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “উঁহু, তুমি তো দুলালবাবু নও হে চাঁদু? আমাদের দুলাল সেন রোগা-ভোগা মাস্টার-মানুষ, তার এত তেজ নেই। তোমাকে দেখতে খানিকটা ওরকম হলেও সে তো নও!”
দুলালবাবুর এই ভয়টাই ছিল। তাঁর চেহারায় দুলালবাবুর আদল থাকলেও একটা মস্ত পরিবর্তনও যে ঘটে গেছে, তা তিনি বেশ টের পাচ্ছেন। কিন্তু তা বলে তা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। তার ওপর প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে। ভ্যাজর-ভ্যাজর করলে তো চলবে না।
দুলালবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “সোজা আঙুলে যে ঘি উঠবে না, তা আমি আগেই জানতুম হে। আমি মুখচোরা আর লাজুক মানুষ বলে তোমরা খুব জো পেয়ে গেছ, না? এবার শঠে শাঠ্যং। আমি আর সেই সাবেক দুলাল নই। টাকাটা ছাড়বে কি না!”
ফটিকবাবু হঠাৎ “বাঁচাও, বাঁচাও, ডাকাত! ডাকাত!” বলে বিকট চেঁচাতে লাগলেন।
দুলালবাবু খপ করে ফটিকবাবুর মুখটা চেপে ধরে অন্য হাতে পটাং করে একটা চড় কষালেন তাঁর গালে। ফটিকবাবু চোখে অন্ধকার দেখে বসে পড়লেন।
দুলাল সেন ঘরে ঢুকে বালিশের পাশে রাখা ফটিকবাবুর মানিব্যাগ থেকে দশটা টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ফটিকবাবুর উদ্দেশে বললেন, “দশটা টাকাই নিলাম, এই দেখে রাখো। সুদ ধরলেও পাঁচ বছরে আরও গোটা পাঁচেক টাকা বেশি হয়। কিন্তু আমি সুদখোর নই বলে শুধু আসলটা নিয়েই ছেড়ে দিচ্ছি।”
আর কোনওদিকে দৃকপাত না করে দুলালবাবু সটান গিয়ে ময়রার দোকানে হাজির হলেন। গরম কচুরির গন্ধে জায়গাটা মাত হয়ে আছে।
দুলালবাবু বাজখাই গলায় হুকুম দিলেন, “দশটা কচুরি আর এক পোয়া হালুয়া।”
নবীন ময়রা দুলালবাবুকে চেনে। নিতান্তই পেটরোগা গোবেচারা মানুষ। জীবনে কেউ তাঁকে দোকানে বসে কুপথ্য করতে দ্যাখেনি। তার ওপর মানুষটার হাবভাবও যেন কেমন-কেমন!
কচুরি ক’টা স্রেফ দু’মিনিটে উড়িয়ে এবং হালুয়া এক মিনিটে নস্যাৎ করে দুলালবাবু উঠে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, “না, এসব হালকা-পলকা জিনিসে কি পেট ভরে?”