‘ঠিকই দেখেছেন। আমাদের রোগাভোগা দুলালবাবুরই এটা অন্য চেহারা।”
“বলো কী? তুমি কি বলতে চাও যে, দুলালবাবু নিজের চেহারা পালটে ফেলতে পারেন? এই বিজ্ঞানের যুগে কি ওসব বুজরুকি চলে?”
শ্যামলাল মাথা নেড়ে বলল, “আমি বিজ্ঞানের বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে বিজ্ঞানও নানারকম ভেলকি দেখাতে পারে। লোকটা যে দুলালবাবুই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”
“তুমি কী করে বুঝলে?”
“আমি নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখেছি।”
“কী দেখেছ?”
“আপনি তো জানেন যে, আমি পনেরো দিন আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই। কাল অনেক রাতে আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু এসে প্রথমে বাড়ির মধ্যে না ঢুকে ল্যাবরেটরির দিকে যাই। কারণ ল্যাবরেটরিতে একটা অদ্ভুত আলো দেখা যাচ্ছিল।”
“বটে!”
“আজ্ঞ হ্যাঁ। শুধু ভালোই নয়, ল্যাবরেটরি থেকে একটি রঙিন বেও বেরোচ্ছিল। আমি গিয়ে কাঁচের শার্শি দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, দুলালবাবু মেঝের ওপর পড়ে আছেন। আমি চট করে ঢুকতে ভরসা পাইনি। ভয় হয়েছিল, এই গ্যাসটা বোধহয় বিষাক্ত। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি ল্যাবরেটরিতে ঢুকে দুলালবাবুকে পরীক্ষা করে দেখলাম, উনি মারা যাননি। তবে নাড়ির গতি বেশ বেশি ছিল। মাঝে-মাঝে কেমন যেন কেঁপে-কেঁপে উঠছিলেন।
ভুবনবাবু এবার ব্যগ্র হয়ে বললেন, “তারপর?”
“তারপর এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। আমার চোখের সামনে দুলালবাবুর চেহারার মধ্যে একটা পরিবর্তন ফুটে উঠতে লাগল।”
“কী রকম পরিবর্তন?”
“প্রথমে দেখলাম, দুলালবাবুর মুখের চামড়ায় যে-সব ভাঁজটাজ ছিল, সেগুলো মিলিয়ে গিয়ে চামড়াটা বেশ টান-টান হয়ে উঠছে। রোগা শরীরটার মাসলগুলো যেন ঠেলে উঠতে চাইছে। আর বয়সটা যেন বেশ কমে যাচ্ছে।”
“বলো কী?”
“আজ্ঞে যা বলছি সব সত্যি। নিজের চোখে দেখা।”
“তখন তুমি কী করলে?”
“প্রথমে ভুতুড়ে কাণ্ড ভেবে একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। তারপর মনে পড়ল, ল্যাবরেটরিতে আমি একটা আলো আর ধোঁয়া দেখেছি। তাই উঠে গিয়ে টেবিলের ওপরটা ভাল করে দেখলাম।”
“কিছু পেলে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। মনে হল, একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণের মতো কিছু ঘটে গেছে। একটা টেস্টটিউবের মধ্যে একটা জিনিস দেখে খুবই অবাক হলাম। সেটা থেকে তখনও একটা বিকিরণ বেরিয়ে আসছিল। অবশ্য দেখতে-দেখতেই সেটা মিলিয়ে গেল। তবু আমি টেবিলের ওপরে রাখা ভাঙা শিশিগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম। আমার মনে হল, দুলালবাবু কোনও একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন।”
“বটে!” ভুবনবাবুর চোখে-মুখে রীতিমত আলো ফুঠে উঠল।
“আজ্ঞে হ্যাঁ। দুলালবাবু বোধহয় যৌবন ফিরে পাওয়ার কোনও ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। শিশিগুলো অধিকাংশই পুড়ে কালো হয়ে গেছে। তবে আমি কয়েকটা শিশির লেবেল থেকে কেমিক্যালগুলোর নাম টুকে নিতে পেরেছি। বাকিগুলো পারিনি।”
ভুবনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এ তো যুগান্তকারী ঘটনা।”
শ্যামলাল বলল, “যে আজ্ঞে। তবে দুলালবাবু ছাড়া এই ঘটনা বোধহয় আর ঘটানো যাবে না। কারণ অন্তত সাত-তাটটা শিশি-বোতল একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
ভুবনবাবু বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, “কুছ পরোয়া নেই। কোন কোন শিশি কাজে লাগানো হয়েছিল, তা অনায়াসে বাই সিম্পল প্রসেস অব এলিমিনেশন বের করা যাবে। আমাদের কাছে সব কেমিক্যালের লিস্ট করা আছে। যেগুলো পাওয়া যাবে না সেগুলোই কাজে লাগানো হয়েছে বলে ধরতে হবে।”
“যে আজ্ঞে।”
“তোমাকে যতটা গবেট মনে করতাম, শ্যামলাল, তুমি বোধহয় ততটা নও। যাকগে, এখন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ব্যাপারটা দেখি।”
.
দুলাল সেন ভুবনবাবুর বাড়ি থেকে সেই যে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকেই তার একটা বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, তিনি আর আগেকার দুলাল সেন নন। আবার পুরনো দুলাল সেনকে যে মন থেকে তাড়াবেন তাও পারছেন না। ফলে এখন একটা মানুষের মধ্যেই দু-দুটো মানুষ ঢুকে বসে আছে।
সবেগে রাস্তা দিয়ে সোজা অনেকটা হাঁটলেন দুলালবাবু। আসলে তার যাওয়ার কোনও তেমন জায়গা নেই। তাঁর তৈজপত্র বলতে যা-কিছু তা হল একটা টিনের সুটকেস আর শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা। তা সে-দুটো ভুবনবাবুর ল্যাবরেটরিতেই পড়ে আছে, উদ্ধার করার কোনও আশা আপাতত নেই। সেখানে নিশ্চয়ই এতক্ষণে পুলিশ গিসগিস করছে। তবে দুলালবাবু জিনিসপত্রের জন্য বিশেষ চিন্তিত নন। তাঁর এখন প্রধান চিন্তা হল, নিজের ভিতর দু-দুটো মানুষকে তিনি সামলাবেন কী করে?
ভেবেচিন্তে তিনি দেখছেন যে তার ভিতরে একটা হল সাবেক দুলাল। সে লোকটা নিরীহ, শান্ত, ভালমানুষ, ভিতু, বুড়োটে। আর একটা হল নতুন দুলাল। সে মহা চ্যাংড়া, গুণ্ডা, ফচকে, ইয়ারবাজ, সাহসী, মারকুট্টে। ফলে দুই দুলালে বনিবনা হচ্ছে না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন, তাঁর ভিতরকার সাবেক দুলাল আর নতুন দুলালের মধ্যে বেশ-একটা ঠেলাঠেলি, ওঁতেওঁতি লেগে পড়েছে। তবে নতুন দুলালের মধ্যে মসমস করছে জোর আর তেজ।
দুলালবাবু হঠাৎ রাস্তা থেকে একটা আধলা ইট তুলে নিয়ে হালদারবাবুর টিনের চালে ধাঁই করে ছুঁড়ে মারলেন। পিলে চমকে দেওয়ার মতো শব্দ হল।
দুলালবাবুর ভিতরকার সাবেক দুলাল হাঁ-হাঁ করে বলে উঠল, “এসব কী হচ্ছে? এসব তো মহা অন্যায় কাজ! এ যে ঘোরতর দুষ্টুমি!”