“পুলিশের সঙ্গে কথা! ও-বাবা। পুলিশের সঙ্গে কথা বলা শুরুর বারণ। বললে আঠারোবার গঙ্গাস্নান করতে হবে। তা বাবু, পেন্নাম হই, আজকের মতো বিদেয় হচ্ছি।”
এই বলে পাঁচু উঠে দাঁড়াল।
ভুবনবাবু কিছু বুঝে উঠবার আগেই পাঁচু একটা বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে জানালায় উঠে চোখের পলকে দু’খানা শিক সরিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল।
ভুবনবাবু চেঁচাতে লাগলেন, “পালাল! পালাল! ধর রে তোরা, ধর!”
চেঁচানিতে লোকজন ছুটে এল। কিন্তু ঘটনাটা কী ঘটেছে; তা বুঝতে যে সময়টা গেল, তাতে পাঁচু মোদকের একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার কথা। তবু লোকে লাঠিসোঁটা আর দড়িদড়া নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে বেরিয়ে পড়ল।
রামলাল তাঁর বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। ওইসব ডেনজারাস লোক যত দূরে থাকে ততই ভাল।”
ভুবনবাবু খ্যাঁক করে উঠলেন, “কাপুরুষের মতো কথা বোলো না। লোকটাকে আমাদের পুলিশের হাতে দেওয়া উচিত ছিল। তোমরা এতগুলো লোক থাকতেও দিনে-দুপুরে সকলের চোখের সামনে দিয়ে একটা জলজ্যান্ত লোক কী করে গায়েব হয়ে যায়, বলতে পারো?”
“লোকটা বোধহয় কোনও ম্যাজিক-ট্যাজিক জানে। কালাচাঁদ সাধু তো দিনে দুপুরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সেইরকমই কিছু…”।
ভুবনবাবু ছেলের দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “এই তোমার বিজ্ঞানমনস্কতা? তুকতাক, মাদুলি কবচ, ভূত-প্রেত এইসব যদি বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাহলে কী হবে জানো? তোমার ল্যাবরেটরিতে ক’দিন পরে ঘাস গজাবে। হুঁ, উনি আবার বিজ্ঞানী! কুলাঙ্গার কোথাকার!”
রামলাল এই ভর্ৎসনায় খুবই লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করলেন।
কিন্তু কথাটা নাবুর খুব লাগল। তিনি যদিও বাবাকে খুবই ভয় পান, কিন্তু তুকতাক ভূত-প্রেত ইত্যাদির অপমান ঠিক হজম করতে পারলেন না খুবই বিনীতভাবে তিনি বললেন, “কিন্তু বাবা, ওসবই আছে।”
ভুবনবাবু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “কী আছে বললে?”
নন্দবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “আজ্ঞে স্বচক্ষেই দেখেছি যে…”
নন্দবাবু ভুবনবাবুর ভাবসাব দেখে দু’পা পিছু হটে বলেন, “আমাদের ভৌত ক্লাবের অনেকেই কিন্তু দেখেছে।”
ভুবনবাব আর একটা হুঙ্কার ছাড়লেন, “ভৌত ক্লাব। কতগুলো পাগল তর ইডিয়ট মিলে একটা গাঁজাখুরি আড্ডা বসিয়েছে, আর তাদের সব গু-গল্প আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমার অধঃপতন দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। ভূত-প্রেত নিয়ে মানুষ কখন মাথা ঘামায় জানো? যখন তার হাতে কোনও কাজ থাকে না। কাজের লোকেরা কখনও বাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। বহুদিন নিষ্কর্মা বসে থেকে-থেকে তোমার মাথাটাই অকেজো হয়ে গেছে।”
নবাবু এই অভিযোগের কোনও সদুত্তর খুঁজে পেলেন না। আসলে বলার মতো অনেক কথাই আছে, তবে সেগুলো এখন বললে ভুবন রায় তাঁকে ছিঁড়ে ফেলবেন।
ভুবন রায় তাঁর দুই অপদার্থ পুত্রের দিকে বাঘা চোখে নীরবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “পাঁচু মোদক, তার শাগরেদ আর আমাদের দুলালবাবু- এই তিনজন লোককে খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। যদিও আমাদের তেমন কিছু চুরি যায়নি এবং খুনখারাবি বা মারদাঙ্গাও হয়নি, কিন্তু এসব ছোটখাটো ব্যাপারকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে। আমার তো ঘোর সন্দেহ হচ্ছে, গত কিছুদিন যাবৎ আমি যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছি, সেগুলোর ফর্মুলা বাগানোর জন্যই দুষ্টু লোকের আনাগোনা শুরু হয়েছে।”
এই সময়ে ভুবন রায়ের তৃতীয় পুত্র শ্যামলাল এসে ঘরে ঢুকল।
শ্যামলালকে বাইরে থেকে বুঝে ওঠা খুবই শক্ত। কারণ শ্যামল কথাবার্তা খুবই কম বলে। তার বয়স পঁচিশের মধ্যেই। এই বয়সেই সে এমন গম্ভীর হয়ে থাকে যে, তাকে ছেলেমানুষ বলে মনে হয় না। সে মাঝে-মাঝে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায় এবং কখনও কখনও এক-দেড় মাস পর হঠাৎ আবার ফিরে আসে। ভুবন রায় প্রথম-প্রথম তাকে খুবই শাসন করতেন। কিন্তু শ্যামলাল নীরবে শাসন-মারধর বকাঝকা সহ্য করে যায়, কখনও প্রতিবাদ করে না, এবং সে কোথায় যায় তাও কাউকে বলে না। ভুবন রায় তাঁর এই রহস্যময় ছেলেটিকে বিশেষ পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু ঘটানও না। দি-পনেরো আগে শ্যামলাল উধাও হয়ে গিয়েছিল।
ভুবন রায় শ্যামলালের দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে বললেন, “তুমি আবার কোথা থেকে উদয় হলে?”
শ্যামলাল জবাব দিল না, নীরবে চেয়ে রইল।
ভুবন রায় বলেন, “তোমরা এক একজন এক একরকম। বাড়িটা ক্রমেই চিড়িয়াখানা হয়ে উঠছে। যাকগে, তোমরা এখন যে যার কাজে যাও। আমি ল্যাবরেটরিতে গিয়ে এখন বিজ্ঞানচর্চা করব, বিজ্ঞান নিয়ে বসে থাকলে মাথায় বাজে জিনিস ঢুকতে পারে না।
শ্যামলাল হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “আমার একটা কথা ছিল।”
“কী কথা?”
“আপনি একটা ভুল করছেন।”
ভুবন রায় এমন অবাক বহুঁকাল হননি। চোখ গোল করে বললেন, “ভুল! আমি!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি বলছেন কাল রাতে আমাদের বাড়িতে দু’জন চোর ঢুকেছিল। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়।”
“তার মানে?”
“চোর একজনই ঢুকেছিল। সে পাঁচু মোদক। দ্বিতীয় লোকটা দুলালবাবু। আপনি দুলালবাবুকে চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু তবু কেন কে জানে তাকে ফের অন্য একটা লোক বলে ধরে নিচ্ছেন।”
ভুবন রায় খুবই অবাক হয়ে বললেন, “রাতের বেলা তাঁকে আমি দুলালবাবু বলে ভুল করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু সকালের আলোয় দেখলাম লোকটার বয়স অনেক কম, দিব্যি তাগড়া চেহারা আর হাবভাবও অন্যরকম।