পাঁচু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “বললে প্রত্যয় হবে না, কিন্তু আমার শাগরেদ টাগরেদ নেই। আগে দু-চারজনকৈ শাগরেদ করে খুব শিক্ষা হয়েছে কিনা, শিখিয়ে-পড়িয়ে যেই মানুষ করলাম অমনি যে-যার নিজের পথ দেখা। তারপর মশাই সেই শাগরেদদের সঙ্গেই পাল্লা টানতে হল। একবার তো গোপেশ্বর ঘটকের ঠাকুরদালানে সেঁদিয়েছি, অমনি ষণ্ডা দারোয়ানটা মহা শোরগোল তুলল। তখন করি কী? তাড়াতাড়ি কুম্ভক করে একেবারে ব্যাঙের মতো চ্যাপটা হয়ে বিগ্রহের সিংহাসনের তলায়, মশাই কী বলব, বেড়ালেরও যেখানে সেঁধোবার জায়গা নেই সেখানে ঘাপটি মারতে গিয়ে দেখি আর এক মক্কেলও সেখানে কুম্ভক করে পড়ে আছে। কার এত ক্ষমতা দেখতে গিয়ে কী দৈখলম জানেন? আমারই এক শাগরেদ। বড় ঘেন্না হল মশাই জীবাটার ওপর। একবার তো ঠিক করেই ফেললুম যে, এ-ব্যবসা আর নয়। কিন্তু নেশাট এমন যে…..”
“তা হলে লোকটি কে?”
পাঁচু চা শেষ করে একটা ঢেকুর তুলে বল, “মিষ্টিটা বড় কম দিয়েছেন, আর দুধটাও বড্ড টানটান এ চা কি ভদ্দরলোকে খেতে পারে? আমাদের চা হবে একেবারে গুড়ে গরগরে, দুধের সর ভাসবে আর চায়ের কাথটিও হবে বেশ ঘন, তবে চা?”
ভুবনবাবু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, “এবার আসল কথায় এস বাপু। বাবুটি কে?”
“আজ্ঞে তা তো আপনাদেরই জানবার কথা। আপনাদের গোয়ালঘরে ভুল করে ঢুকে পড়ে ভারি কেলেঙ্কারিতে পড়ে গিয়েছিলুম। সেইখানে বাবুটিও পড়েছিলেন। ঘরে কেমন যেন বিদঘুঁটে একটা গন্ধ, আর ধোঁয়াটে ভাব। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমাকে এমন ধরলেন যে, প্রাণ যায় আর কি। দেখলুম, বাবুটি বোকাসোকা ভালমন্দ গোছের, গোবরগণেশই বলা যায়, ছিটিয়ালও বটেন। কিন্তু মানুষটি বেশ ভদ্র, নিজের নামই তাঁর মনে নেই। আমার বড় কম ধকল যায়নি মশাই বাবুটিকে নিয়ে। তার একটা নাম দিতে হল, কাজটাজও শেখাতে হল, তারপর তো সবই জানেন।”
“তা হলে বাবুটিকে তুমি চেনো না?”
পাঁচু মাথা চুলকে বলল, “একেবারে চিনি না বলাটা কী ঠিক হবে। মুখোনা চেনাই বটে, তবে নামধাম জানি না। আমার আবার বড়লোকদের সঙ্গে কারবার। গরিব গুবোদের তত্ত্ব খুব বেশি জানা নেই। বাবুটি বোধহয় মাস্টারি-টাস্টারি কিছু করতেন।”
ভুবনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ভিজে বেড়াল। যাকগে, প্রশ্ন হল, সেই মাস্টারমশাই গেলেন কোথায়? তাঁকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আর একটা লোক কোথা থেকে এসে উদয় হয়েছিল, রীতিমত গুণ্ডা প্রকৃতির। লোকটা পালিয়ে গেছে। এই দু’নম্বর লোকটা কে?”
“আজ্ঞে, আমি দু’নম্বরদের কথা কিছু জানি না।”
“খুব জানো। না জানলে চলবে কী করে? এই গুণ্ডা লোকটা দুলালবাবুকে হয় গুম না হয় খুন করেছে।”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “অঙ্কটা মিলছে না।”
“তার মানে?”
পাঁচু একগাল হেসে বল্ল, “আপনারা লেখাপড়া জানা লোক তো! তা লেখাপড়া জানা লোকদের একটা ভারি মুশকিল হয়। তারা নিজেদের বুদ্ধি তেমন খাটাতে পারে না। মাথাটা অন্য সব পণ্ডিতদের কাছে বাঁধা রাখা থাকে তো! আপনারা হলেন সব লেখাপড়া জানা লোক! আমাদের মাথায় ওসব আজেবাজে আগডম-বাগডম জিনিস নেই। যা পাবেন তা খাঁটি জিনিস।”
“আচ্ছা বেয়াদব তো।”
পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা আজ্ঞে বেয়াদবি হয়তো একটু হচ্ছে। কিন্তু আপনাদের বুদ্ধিরও বলিহারি যাই। দুটো লোককে আপনার পেলেন কোথায়? লোক তো একটাই। আপনাদের চোখের সামনেই লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারপর যখন পাশ ফিরল তখন সেই লোকটাই অন্য লোক হয়ে গেল কীভাবে?”
ভুবনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমাদের দুলালবাবু মোটেই চোর ছিলেন। গুণ্ডা তো হওয়ার উপায়ই তাঁর নেই। তা ছাড়া ওরকম হাবভাব আর হাতের গুলিও তার কস্মিনকালে ছিল না। সুতরাং আমাদের চোখে ধূলো দেওয়া অত সহজ নয় হে। লোক দুটোই ছিল। একজন দুলালবাবু, অন্যজন তোমার শাগরেদ।”
পাঁচু মাথাটা নেড়ে নেড়ে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “না মশাই, অঙ্কটা ঠিকঠাক মিলছে না। আমাকেই মেলাতে হবে। এসব আপনাদের কর্ম নয়। বাবুটিকে খুঁজে তো আগে বার করি।”
“তার মানে? তোমাকে কি আমি ছেড়ে দিচ্ছি নাকি? মোটেই ভেবো না যে, চালাকি করে পালাবে। পুলিশ আসছে।”
পাঁচু মিষ্টি করে হেসে বলল, “এজন্যই তো লেখাপড়া-জানা লোকদের কিছু হয় না। মাথাটা খেলে না কিনা। পাঁচু মোদক কি এতই সোজা লোক মশাই? পুলিশ ডেকে তাকে ধরাবেন! গত ষাট বছরে এই শর্মা একবারও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি, তা জানেন?”
ভুবন রায় ভারি অবাক হলেন। ডাকসাইটে ভুবন রায়ের মুখের ওপর কথা বলার মতো বুকের পাটাওয়ালা লোক তা হলে এখনও এই শহরে আছে? তাও আবার একটা ছিচকে চোর! এত অবাক হলেন যে, তিনি কথাই বলতে পারলেন না।
পাঁচু মোদক যথেষ্ট অভিমান-ভরা গলায় বলল, “এইরকম ঘরে আটকে রেখে আপনারা আমাকে কী অপমানটাই না করলেন। পাঁচু মোদককে আটকাতে হলে লোহার ঘর লাগে মশাই। তাও পেরে উঠবেন না। লোহা কেটে পাঁচু ঠিক পালাবে। আমি তো লজ্জায় অধোবদন হয়ে আছি তখন থেকে। মনে-মনে ভাবছি, ওরে পাঁচু, তোর হল কী? তোকে যে এরা কুকুর-বেড়ালের সমান জ্ঞান করছে!”
ভুবনবাবুর গলাধাকরি দিয়ে বললেন, “বেশি কথা বলার দরকার নেই। পুলিশ আসছে! যা বলার তাদের কাছে বোলো।”