“একটু এদিকে আয়। তোর সঙ্গে একটা গোপন কথা আছে।” রামলাল ভুতোকে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে একগাল হাসলেন।
“তুই বেশ ভাল ছেলে।”
ভুতো এই প্রশংসাবাক্যে খুবই অবাক হল। কারণ, রামলাল বিজ্ঞানের লোক বলে ভুতোকে মোটেই পছন্দ করেন না। ভুতোকে যে পরি নিয়ে গিয়েছিল বা ভুতো যে অনেক সময় অনেক অশৈলী কথা বলে ফেলে, তাকে তিনি বুজরুকি বলেই মনে করেন। আর ভুতো এইসব কারণে রামলালের চক্ষুশূল। কাজেই আজ এই সমাদর দেখে ভুতো মনে-মনে প্রমাদ গুনল।
রামলাল ওপরের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ গলা চুলকোলেন। তারপর বললেন, “বুঝলি ভুতো, আমাদের দুলালবাবু এই ঘরেই রাতে কোনও এক সময়ে, মানে, কী যে হয়েছিল, তা আমি ঠিক জানি না। তবে সকাল থেকে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝলি?”
ভুত চোখ গোল করে বলল, “ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?”
রামলাল মাথা নেড়ে বললেন, “না, খুঁজে এখনও দেখিনি অবশ্য। তবে দেখে লাভও নেই। বলছিলাম কি, ভুতো, তোর তো সব ইয়েটিয়ে আছে শুনতে পাই। ওই কী যেন বলে।”
ভুত মাথাটা নীচু করে বলল, “আমার কী আছে?”
রামলাল খুব আমতা-আমতা করে বললেন, “আমি হলাম তো বিজ্ঞানের লোক, বুঝলি! আমি ওসব বিশ্বাস-টিশ্বাস করি না।”
ভুতো খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “বিশ্বাস করার দরকার কী?”
রামলাল গলাটা কষে আবার চুলকে নিয়ে বললেন, “না, মানে, বিশ্বাস না করলেও, বলছিলাম কি, বিজ্ঞানের বাইরেও তো কত জিনিস আছে। আমরা আর কতটুকু খবর রাখি বল।”
ভুতো মাথা নেড়ে বলল, “বিজ্ঞানের বাইরে আবার কী থাকবে?”
রামলাল ভুতোর ঘাড়ে হাত রেখে মিষ্টি করে একটু হেসে বললেন, “বলছিলাম কি, যদি দুলালবাবুর একটা হদিস তোর ওই পরিরা দিতে পারে, তবে বড় ভাল হবে।”
ভুতো অবাক হয়ে বলল, “দুলালবাবুর জন্য পরিদের ডাকাডাকি করে কী হবে? আমরা সবাই মিলে খুঁজে ধরে নিয়ে আসছি।”
রামলাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “তাহলে খুব ভাল হয় বাবা। জ্যান্ত বা মরা যে-কোনও অবস্থাতেই তাকে খুঁজে পাওয়াটা খুব দরকার। নইলে আমাকে কাঠ-উপোস করে থাকতে হবে।”
.
ডিগবাজি খেয়ে ভুবন রায়ের মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন, পাঁচু মোদক যদিও চোর এবং অনধিকার অনুপ্রবেশকারী তবু অতিথি তো! একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
তিনি যখন তালা খুলে নীচের তলার অন্ধকার ঘরখানায় গিয়ে ঢুকলেন, তখন হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরা। ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করলে বা পালাতে চেষ্টা করলে কাজে লাগবে।
ঘরে ঢুকে দেখলেন, পাঁচু মোদক মেঝের ওপর শুয়ে ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। তবে সাড়া পেয়ে উঠে বসল। পালানোর কোনও চেষ্টাই করল না। প্রকাণ্ড হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “সারারাত বিস্তর ধকল গেছে মশাই, কাঁচা ঘুমটা কি না ভাঙালেই চলত না?”
ভুবন রায়ের সঙ্গে এরকমভাবে কেউ কথা বলে না। কাজেই তিনি একটু দমে গিয়ে বললেন, “তোমাকে তো ঘুমনোর জন্য ধরে রাখা হয়নি।”
পাঁচু মোদক ‘ফুঃ শব্দ করে গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “ধরে তো রেখেছেন কচু। জানালার তিনটে শিক নড়বড় করছে, পশ্চিমের দেওয়ালটা এক জায়গায় নোনা ধরে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। পাঁচুকে ধরে রাখা অত সহজ নয় মশাই। ইচ্ছে করলেই পালাতে পারতুম। শুধু পাগলা বাবুটির খবর না নিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না বলেই এখনও আছি।”
“বটে!”
পাঁচু মাথা নেড়ে বলল, “তা বাবু, এটা কি ভিখিরির বাড়ি, নাকি হাড় কেপ্পনের আচ্ছা?”
“কেন বলো তো?”
“সকাল থেকে দাঁতে দানাটা কাটিনি, কেউ একটু খবরও নিল না মশাই। এটা কী রকম ব্যবহার আপনাদের?”
ভুবন রায় এবার লজ্জিত হলেন। চোর-ছ্যাচড় যাই হোক, একটু তদারক করা দরকার ছিল।
ভুবন রায় বললেন, “কিছু মনে করে না বাপু, ঝামেলায় একটু দেরিই হয় গেছে। বোসো, খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে।”
পাঁচু গম্ভীর গলায় বলল, “একটু মোটা ব্যবস্থাই করবেন। গরিবের খিদে একটু বেশি কিনা।”
ভুবন রায় কাজের লোকদের ডাকাডাকি করলো জলখাবারের হুকুম হল। এবং একটু বাদে ছ’খানা গরম রুটি আর আলু-কপির তরকারি সাজিয়ে দেওয়া হল পাঁচুর সামনে।
পাঁচু ঠা-ঠা করে হেসে উঠে বলল, “ছ’খানা! ছ’খানা! উরে বাবা, হাসতে হাসতে মরে যাব। এ যে আমার চেয়ে গরিব লোকের বাড়ি, অ্যাঁ!
ভুবন রায় উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এটা কি মামার বাড়ি নাকি হে বেয়াদব? ওই ছ’খানার বেশি একখানাও আর নয়। বেশি খাওয়া আমি একদম পছন্দ করি না।”
পাঁচু আর দ্বিরুক্তি না করে খাওয়া শুরু করে দিল। বলল, “একটু চা পাব। তো কাবাবু? বেশ বড় এক গেলাস? চায়ে অভ্যেস অবশ্য আমার নেই। দুধই খাই, তা আপনাদের মতো কেপ্পনের বাড়িতে তো আর দুধের আশা নেই। চা দিয়েই চালাতে হবে। তবে একটু যেন বেশি করে দুধ দিয়ে করে, দেখবেন।”
খাওয়া শেষ করার পর চায়ের গেলাসটি হাতে নিয়ে পাঁচু খুব ভাবুকের মতো ভুবনবাবুর দিকে চাইল।
ভুবনবাবু আগাগোড়া তার হাবভাব তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিচ্ছিলেন। লোকটাকে তাঁর খুব উঁচুদরের ঘড়েল বলে মনে হচ্ছিল। অমায়িক, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ধূর্ত।
ভুবনবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে তৈরি হলেন। বললেন, “দ্যাখো বাপু, তুমি অত্যন্ত পাজি লোক। তোমার ব্যবস্থা পরে হবে। কিন্তু তোমার শাগরেদটির পরিচয় আমাদের আগে দরকার।”