রমলাল সভয়ে দু’পা পেছিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি নন্দবাবুর দিকে আঙুল তুলে বলে উঠলেন, “আমি না, ও।”
“বটে!” বলে দুলালবাবু নন্দলালের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন।
নন্দবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “আমি মোটেই বলিনি যে, আপনাকে আটকে রাখব। কোন্ দুঃখে বলুন?”
দুলালবাবু একটা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “পুলিসকে খবর দিয়েছে কে?”
রামলাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠলেন, “কেউ দেয়নি। দেওয়ার কথা ভাবিনি পর্যন্ত আমরা।”
নিজের দুই কাপুরুষ সন্তানকে খুব সমালোচকের চোখে লক্ষ করছিলেন ভুবন রায়। তাঁর ছেলে হয়ে এরা যে কেন এত ভীরু আর দুর্বলচিত্ত হল, তা তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।
কিন্তু ভুবন রায় নিজে কাপুরুষ নন। রীতিমতো সাহসী ও সক্ষম। সুতরাং তিনি বললেন, “দেখুন মশাই, আপনাকে আমিই পুলিশে দেব বলেছি।”
দুলাল সেন হো-হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বুক ফুলিয়ে বললেন, “পুলিশ আসার আগেই আমি সরে পড়ছি। যদি পারেন তো আটকানোর চেষ্টা করুন।”
এই বলে দুলালবাবু দরজার দিকে এগোতেই ভুবনবাবু তাঁর মজবুত বেতের লাঠিটা বাগিয়ে পথ আটকালেন। দুলাল সেন অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভুবন রায়ের হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে স্রেফ দু’হাতের চাপে মটাত করে দুমড়ে ফেললেন। তারপর গটগট করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাওয়া হয়ে গেলেন।
নন্দলাল, রামলাল আর ভুবনবাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
.
ভুবনবাবু যে চটেছেন, তা তাঁর কান দেখলেই বোঝা যায়। ভুবন রায়ের কান তখন নড়ে। ভয়ঙ্কর রেগে গেলেই এটা হয়।
তিনি তাঁর দুই অপদার্থ ছেলের দিকে রোষকষায়িত-লোচনে চেয়ে কিছুক্ষণ তাঁদের ভস্ম করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর অতিশয় শীতল কঠিন গলায় বললেন, “তোমরা অপদার্থ, ভীরু এবং কাপুরুষ। তোমাদের মতো ছেলেকেই শাস্ত্রে কুলাঙ্গার বলা হয়ে থাকে রামলাল!”
“যে আজ্ঞে।”
“দুলালবাবুর লাশ যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে লেগে যাও। মনে রেখো, লাশ পাওয়া না গেলে তোমার অন্নজল বন্ধ, নন্দলাল!”
“আজ্ঞে বলুন।”
“তুমি অত্যন্ত অকর্মণ্য আর বায়ুগ্রস্ত হয়ে পড়ছ। তোমার ভিতরে একটা ভালরকম ওলটপালট দরকার। যাও, নীচে ভিতরের ঘেরা মাঠে একনাগাড়ে দেড়শো ডিগবাজি খাও। গুনে-গুনে দেড়শো। আমি জানালা নিয়ে নজর রাখব।”
রামলাল আর নন্দলাল দু’জনেই মাথা চুলকোতে লাগলেন। কিন্তু জানেন, ভুবন রায়ের আদেশ অমান্য করলে ঘোরতর সমস্যা দেখা দেবে।
রামলাল কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ইয়ে আমার মনে হচ্ছে দুলালবাবু মরেননি। কাজেই তাঁর লাশও পাওয়া যাবে না।”
“দুলালবাবু যদি না-ই মরে থাকেন, তবে গেলেন কোথায়?”
রামলাল এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলেন না। তাই মাথা চুলকোতে-চুলকোতে লাশ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন।
নন্দবাবু বিরস মুখে ভিতরের ঘেরা-মাঠে নেমে সভয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। ভাইপো-ভাইঝিরা কাছাকাছি আছে কি না। তারপর নিতান্তই অনিচ্ছের সঙ্গে এবং রাগে গরগর করতে করতে ডিগবাজি খেতে শুরু করলেন।
দেখতে-না-দেখতে পিলপিল করে ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নিরা এসে জুটে গেল চারদিকে। এত বড় একটা মানুষকে প্রকাশ্যে ডিগবাজি খেতে তারা কখনও দ্যাখেনি।
“ও কাকু, তুমি ডিগবাজি খাচ্ছ কেন?”
“কাকু, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?”
“মামা গো, তুমি তো দিব্যি ডিগবাজি খেতে পারো দেখছি!”
নন্দবাবু হাসি-হাসি মুখে করে বললেন, “ডিগবাজি খাওয়া খুব ভাল। সাহেবরা বলে, ডিগবাজিতে স্মৃতিশক্তি বাড়ে, গায়ে জোর হয়, খিদে হয়।”
“তা হলে আমরাও খাই?”
“যা-না, খা। যত খুশি খা।”
সঙ্গে সঙ্গে মাঠময় ডিগবাজির হররা পড়ে গেল। এতে নন্দবাবুর মনের জ্বালাটা একটু জুড়োল। বেশ ভালই লাগতে লাগল তাঁর। দেড়শোর জায়গায় তিনি ও শ’দুই ডিগবাজি খাবেন বলে মনে-মনে স্থির করে ফেললেন।
ওপরের জানালা দিয়ে দৃশ্যটা খুব মনোযোগ দিয়েই দেখলেন ভুবন রায়। দেখতে-দেখতে তাঁর শৈশবের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ডিগবাজি খাওয়া, আর্চ করা, ব্যাঙ লাফ দেওয়া, কত কী করেছেন ছেলেবেলায়।
ভুবন রায় আর থাকতে পারলেন না। দোতলা থেকে তরতর করে নেমে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ডিগবাজি খেতে শুরু করলেন।
কাণ্ড দেখে নন্দবাবু ভয়ে জড়োসড় হয়ে বললেন, “বাবা, করছেন কি? এই বয়সে ডিগবাজি খাচ্ছেন, কোমর-টোমরে লেগে যাবে যে!”
ভুবন রায় ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “এ তো তোমাদের মতো পলকা কোমর নয়। ভুবন রায়ের কোমরের ওপর ইমারত তোলা যায় বুঝলে! দেখলুম তো, মাত্র দেড়শোটা ডিগবাজি খেতেই তোমার জিভ বেরিয়ে গেল। দেখবে, সত্যিকারের ডিগবাজি কাকে বলে? তবে দ্যাখো।” বলে ভুবনবাবু আবার টপাটপ ডিগবাজি খেতে লাগলেন।
এমন সময় ওপর থেকে একজন দাসী এসে বলল, “কতাবাবু আপনার মা আপনাকে আর ডিগবাজি খেতে মানা করে দিয়েছেন।”
ভুবনবাবু মাকে ভক্তিও করেন, ভয়ও খান। সুতরাং ক্ষান্ত দিলেন। নাতি নাতনিরা ভুবনবাবুকে ভয়ঙ্কর ভয় পায়। তাঁর ডিগবাজি দেখে সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিল। ভুবনবাবু চলে যাওয়ার পর ফের সবাই হল্লা শুরু করে দিল।
একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে রামলাল সন্তর্পণে ভুতোকে ডাকলেন, “ভুতো, ভুতো, শুনে যা বাবা।”
ভুতো একটু অবাক হয়ে এগিয়ে গেল, “কী বলছেন?”