চড় খেয়ে নন্দবাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন। ক্রমে সেই অন্ধকারে অনেক সরষে ফুল ফুটে উঠতে দেখলেন। তাঁর পায়ের তলা থেকে মেঝেটাও কে যেন, কার্পেটের মতো টেনে নিল। নন্দলাল কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেলেন।
রামলাল এই কাণ্ড দেখে তড়াক করে দরজার ওপাশে গিয়ে লাফ দিয়ে পড়লেন। একসময়ে তিনিও দুলালবাবুর ছাত্র ছিলেন। আর দুলালবাবুর মস্ত দোষ হল একজন ছাত্র দোষ করলে শুধু তাকে মেরেই ক্ষান্ত হতেন না, আরও দু পাঁচজনকে ফাউ হিসাবে ঠেঙিয়ে নিতেন। সেই কথা রামবাবুর খুব মনে আছে। ভুবনবাবু নীরবে দৃশ্যটা দেখলেন। কয়েক সেকেন্ড হাঁ হুঁ কিছু করলেন না।
তবে হাঁ করে যেমন চেয়েছিলেন, তেমনিই চেয়ে রইলেন দুলালবাবুর দিকে।
দুলালবাবু তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “বেয়াদবটার কথা শুনলেন? আমি নাকি রাত পটোয়….”
ভুবনবাবু একটা মস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁ বন্ধ করলেন। তারপর দুলালবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “বলবান লোক আমি পছন্দই করি দুলালবাবু। আপনার গায়ে যে যথেষ্ট জোর হয়েছে, এতে আমি খুবই খুশি। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য গায়ের জোর খাটানোটা বোধহয় ভাল কাজ নয়।”
দুলালবাবু মাথা চুলকোতে লাগলেন। বললেন, “আপনার মতো মান্যগণ্য লোককে কী করে বলব। কিন্তু কথাটা ডাহা মিথ্যে।”
ভুবনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “মোটেই মিথ্যে নয়। কাল যে মাঝরাত্তিরে আপনি রান্নাঘরে ঢুকে খেয়েছেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। আর বাসনকোসনও যে সরিয়েছিলেন তার সাক্ষী হিসেবে পাঁচু মোদক নামে একটা লোককেও নন্দলাল ধরে এনেছে। সে আমাদের নীচের তলার ঘরে বসে রয়েছে।”
দুলালবাবুর চোখ দুখানা বিস্ফারিত হয়ে গেল, “পাঁচু মোদক? কস্মিনকালেও এরকম নাম শুনিনি।”
“শুধু তাই নয় দুলালবাবু, নন্দলালের কাছে ধরা পড়ে নিজেকে আপনি পাঁচু মোদক বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর আপনি যে চুরি করতেই বাড়িতে ঢুকেছেন, সে-কথাও কবুল করেছেন। ঘটনা অনেক ঘটে গেছে দুলালবাবু, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে, আপনি আমাদের আসল দুলালবাবু নন। আমাদের দুলালবাবু ছিলেন রোগা মানুষ, বুড়ো, কানে একেবারেই শোনেন না, নিরীহ। কিন্তু আপনি রীতিমতো স্বাস্থ্যবান, হিংস্র, সুপুরুষ। সুতরাং আমি জানতে চাই, আপনি লোকটা কে? আর আমাদের আসল দুলালবাবুই বা কোথায় গেলেন? আমার ঘোরতর সন্দেহ, আসল দুলালবাবুকে আপনি গুম করেছেন। খুনও করে থাকতে পারেন।”
দুলালবাবু এত অবাক হলেন যে, মুখ দিয়ে বাক্য সরল না। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, “এ-সবের মানে কী? কী সব বলছেন ভুবনবাবু?”
ভুবনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “অস্বীকার করছি না যে, আপনার সঙ্গে দুলালবাবুর চেহারার অনেক মিল আছে। কিন্তু মিল থাকলেই যে একজন অন্যজন হয়ে যা-খুশি করবেন, তা তো হয় না!”
দুলালবাবু এবার নিজের দিকে তাকানোর একটা অক্ষম চেষ্টা করলেন। তাঁর মনে হল, তিনি আগের মতো রোগা নেই। হাত-টাতগুলো বেশ সবল আর শক্তিমান দেখাচ্ছে। ছাতিটাও চওড়া মনে হচ্ছে। গায়ে বেশ শক্তি অনুভব করছেন। না, তিনি তো বাস্তবিকই তা হলে দুলাল সেন নন।
দুলালবাবু হঠাৎ বললেন, “আপনার কাছে আয়না আছে!”
ভুবনবাবু পশ্চিমের দেওয়ালে টাঙানো আয়নাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই তো!” দুলালবাবু গিয়ে আয়নায় নিজের মুখোনা ভাল করে দেখলেন। সেই আগেকার রোগা ভাঙা বুড়োটে মুখ এ তো নয়। রীতিমতো অল্পবয়সী একটা মুখ। দুলালবাবু হঠাৎ বুঝতে পারলেন, কোথায় একটা বস্ত বড় গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
ভুবনবাবু বললেন, “কী হল, আপনি কে তা বুঝতে পারলেন?”
দুলালবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না। ঠিক চিনে উঠতে পারছি। অথচ চেনা-চেনা ঠেকছে।”
“তা হলে?”
দুলালবাবু মাথা চুলকে বললেন, “তা হলে…”
ভুবনবাবু অত্যন্ত কঠিন চোখে দুলালবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিত কি না?”
নন্দবাবু থাপ্পড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। এবার গালটা হাতের তেলোয় ঘষতে ঘষতে উঠে বসে বললেন, “খুব উচিত।”
দুলালবাবু আর একবার ভাল করে নিজের মুখোনা দেখলেন। প্রথমটায় ঘাবড়ে গেলেও বারবার দেখার পর নিজের মুখোনা তাঁর বেশ পছন্দই হল। এর আগে তাঁর যে রোগা, ভাঙা লম্বাটে, বুড়োটে মুখোনা ছিল, সেটা তাঁর বিশেষ পছন্দও ছিল না। তাই আয়নায় মুখ দেখা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। মুখোনা দেখতে-দেখতে তিনি খুশি হয়ে একটু হেসেও ফেললেন। তারপর হঠাৎ বুদ্ধি খাঁটিয়ে বললেন, “কিন্তু পুলিশে দেবেন কাকে? আমি যে কে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
ভুবনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “পুলিশের ভয়ে ওরকম অনেকেই নিজের পরিচয় গোপন করে। তঁতোর চোটে নামধাম সবই শেষে বেরিয়ে পড়ে।”
রামলাল একটু ভয়েভয়ে ফের ঘরে ঢুকে বললেন, “তা ছাড়া কাল রাতে কে বা কারা আমাদের ল্যাবরেটরিতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমার মনে হয়, তাতে আপনার হাত থাকা অসম্ভব নয়। আমার আরও মনে হয়, দুলালবাবু কোনও একটা অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। আর সেটা নষ্ট করার জন্যই আপনি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।”
দুলালবাবু নিজের মুখ দেখতে-দেখতে বেশ নেশায় পড়ে গেছেন। বাঃ ভারি ভাল দেখতে লাগছে তো মুখোনা। আর শরীরটাও যেন শক্তপোক্ত দেখাচ্ছে। গায়ে-গতরে যেন শক্তির একটা বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হাত-পা নিশপিশ করছে কিছু একটা করে ফেলার জন্য। তিনি সুতরাং হাতের গুলি ফুলিয়ে রামলালের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “কিন্তু আমাকে আটকে রাখবে কে? পুলিশের হাতেই বা তুলে দেবে কে? তুমি নাকি?”