নন্দবাবু তাকে ডেকে বললেন, “ওহে নরহরি, তোমার ভয় নেই। পালিও না।”
পাঁচু ওরফে নরহরি একটা গাছের আড়াল থেকে বলল, “ভয় আছে কি নেই, সেটা বুঝব কী করে?”
নন্দবাবু খুশিয়াল গলায় বললেন, “তোমার দৌড় দেখে আমি খুশিই হয়েছি।”
পাঁচু চাপা গলায় বলল, “আজ্ঞে কর্তা, আপনিও কিছু কম যান না।”
নন্দবাবু বললেন, “হেঃ হেঃ, তা বলতে পারো বটে। দৌড়ঝাঁপে আমার কিছু এলেম ছিল এককালে।”
“এখনও আছে।” বলে বিগলিত মুখে পাঁচু শিশুগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। সে বুঝে গেছে, আজ রাতে এ-শহরে পাগলের সংখ্যা বেজায় রকমের বেড়ে গেছে।
নন্দবাবু ভৌত ক্লাবের ভেজানো দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলে বললেন, “এসো, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। বড্ড জলতেষ্টা পেয়েছে।”
পাঁচুরও যথেষ্ট ধকল গেছে। এই বয়সে এত হুটোপাটি কি সয়? সেও নন্দবাবুর পিছু পিছু ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর বসে পড়ল, “যে আজ্ঞে”।
নন্দবাবু মোমবাতি জ্বাললেন, তারপর কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেলেন। তারপর পাঁচুর দিকে চেয়ে বললেন, “এটা কিসের ক্লাব জানো?”
পাঁচু একগাল হেসে বলল, “তা আর জানব না? এ হল ভুতুড়ে কেলাব।”
“ভৌত-ক্লাব।”
“ওই হল। আপনারা সব সাঁঝের বেলায় এখানে বসে ভূত-প্রেত নামানোর জন্য চেষ্টা করেন। তবে তাঁরা নামেন না।”
নন্দবাবু মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ঠিকই বলেছ, আমাদের একজন তো ভূত দেখার জন্য কত চেষ্টাই করলেন। শালার কাছে তাঁর মুখ দেখানোই ভার হয়েছে।”
পাঁচু খুব হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, “আজ্ঞে, ভূতের কোনও অভাব নেই। চারদিকে মেলা ভূত।
নন্দবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, “বলো কী।”
পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরা হলুম তো রাতচরা মানুষ। নিশুতি রাতেই আমাদের কাজ কারবার শুরু হয় কি না, আমরা তো বিস্তর ভূত দেখতে পাই।”
নন্দবাবু সাগ্রহে বললেন, “কেমন?”
“এই তো পরশু দিনই নিস্তারিণী ঠাকুমাকে দেখলুম। কদমতলার বেলগাছ থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছেন। গতকালও বগলা দত্তের সঙ্গে দেখা, পুকুরে নেমে চান করছিলেন। তারপর ধরুন, কুমোরপাড়ার মোড়ে যদি যান, দেখবেন নাথু মুচি বসে বসে জুতো সেলাই করছে, তার একটু দূরেই হারা নাপতে চুল ছাঁটছে। তারপর ধরুন, এই ভৌত-ক্লাবের পিছনেই তো গত তিনশো বছর ধরে হরিহর মিত্রমশাই বসবাস করে যাচ্ছেন। সেই চুনোট ধুতি, গোঁফে সেই তুরতুরে আতর, গিলে কলা পাঞ্জাবি, পাঁচ আঙুলে পাঁচখানা আংটি, তেমনি দাপুটে মেজাজ। এখনও কথায় কথায় মোহর বখশিশ করেন, চটে গেলে চাবুক।”
‘অ্যাঁ! তা দেখাতে পারো?”
“সে আর শক্ত কী? তবে কিনা…”
৬. দুলালবাবুর যখন চেতনা ফিরল
দুলালবাবুর যখন চেতনা ফিরল তখন সকাল হয়েছে। ঘরে পুবের জানালা দিয়ে বেশ খানিকটা রোদ এসে ঘরটা ঝলমল করছে আলোয়। আর সেই আলোয় ভুবন রায় ভূত-দেখা চোখে দুলালবাবুর মুখের দিকে চেয়ে কাঠ হয়ে বসে আছেন।
দুলালবাবু নিজের পরিস্থিতিটা বুঝতে একটু সময় নিলেন। তিনি প্রথম যে জিনিসটা বুঝতে পারলেন, সেটা অতিশয় বিস্ময়কর। বাইরে পাখি ডাকছে। বহুঙ্কাল পাখির ডাক শোনেননি। আরও অনেক কিছুই শোনেননি। হঠাৎ পাখির ডাক এত জোরে কানের পর্দায় এসে লাগছিল যে, তিনি দু’কানে আঙুল দিয়ে উঠে বসলেন।
তারপর ভুবনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “বড্ড বেশি আওয়াজ করছে পাখিগুলো।”
ভুবন রায় এমন কাঠ হয়ে বসে আছেন যে, তাঁকে তাঁর স্ট্যাচু বলে মনে হচ্ছিল। দুলালবাবুর কথায় হ্যাঁ-না কিছুই করলেন না, তবে খানিকটা হাঁ করে যেমন চেয়েছিলেন তেমনিই চেয়ে রইলেন।
দুলালবাবু দুটো কান দুই আঙুলে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে নিয়ে বললেন, “বেশ খিদেও হচ্ছে মশাই। পেট রীতিমতো চোঁচোঁ করছে।”
কে যেন পিছন থেকে অত্যন্ত বিস্মিত গলায় বলে উঠল, “খিদে? আপনার আবার খিদে পাচ্ছে?”
দুলালবাবু ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখলেন, দরজার কাছে আরও দুটো প্রস্তরমূর্তি। একজন রামলাল, অন্যজন নন্দলাল। দুজনের মুখই একটু করে হাঁ।
দুলালবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “কেন বাপু, খিদে পাবে না-ই বা কেন? খিদে পেলে কি দোষ হয় কিছু? নাকি তোমাদের বাড়িতে খিদে পাওয়ার নিয়ম নেই? এমন ভাবখানা করছ যে, খিদে কথাটা জীবনে এই প্রথম শুনলে। বলি তোমাদের খিদে-টিদে পায় না?”
দুলালবাবুর এরকম কড়া ধমকানিতে নন্দবাবু বেশ ঘাবড়ে গিয়ে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে আমতা-আমতা করে বললেন, “না, খিদের আর দোষ কী? খিদে পেতেই পারে। আমাদেরও পায়। তবে কিনা কাল রাত দুটোর সময় আপনি একাই এক পালোয়ানের ভোজ খেয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি আবার খিদে পেয়ে থাকলে ভালই, স্বাস্থ্যের লক্ষণ! তার মানে হজমটজম ভালই হচ্ছে। আর ইয়ে…”
দুলালবাবু নিজের এই বেয়াদব ছাত্রটির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে বললেন, “কাল রাত দুটোয় কে আমাকে ভোজ খাওয়াল বলো তো? আমি
তো নেমন্তন্নবাড়িতে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি।”
নন্দবাবু সখেদে বললেন, “নেমন্তন্ন তো আপনাকে করাও হয়নি স্যার। আপনি নিজেই আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে স্বহস্তে নিজেকে পরিবেশন করেছেন। তারপর বাসনগুলো বেঁধে নিয়ে আপনার শাকরেদদের হাতে চালান করে এলেন। সব স্বচক্ষে দেখা।”
দুলালবাবু আর সহ্য করতে পারলেন না। টপ করে দাঁড়িয়ে নন্দলালের গালে চটাস করে একখানা চড় বসিয়ে বললেন, “বাঁদর ছেলে, আবার মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে!”