স্যুটের সঙ্গে মানিয়ে আজ বুটজুতোও পরেছেন তিনি। বহুঁকাল পড়ে ছিল বুট দুটো, শক্ত দরকচা মেরে গেছে। পায়ে সাঙ্ঘাতিক লাগছে হাঁটতে গিয়ে। হেলমেটটাও যে এত ভারী, তা কে জানত!
গলিটা পার হয়ে নন্দবাবু রাস্তায় পড়লেন। শীতকাল। মফস্বলের শহরে খুব জেঁকে শীতও পড়েছে এবার। রাস্তায়-ঘাটে লোকজন বিশেষ নেই। থাকলেও ক্ষতি ছিল না, এ রাস্তায় আলো নেই, এবং ঘন কুয়াশা পড়েছে আজ। সুতরাং নন্দবাবুকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
নন্দবাবু ধীর গম্ভীর মানুষ, তার কোনও চপলতা দেখা যায় না কখনও। কিন্তু আজ এই কুয়াশামাখা সন্ধ্যায় সুট, বুট এবং হেলমেট পরে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার শিস দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। একটু ইংরেজি নাচ নাচতে ইচ্ছে করছিল।
নন্দবাবু বললেন, “ওরে মন, মন রে! এসব হচ্ছেটা কী?”
“খারাপটা কী হচ্ছে বাপু! শিস দিতে ইচ্ছে হলে দাও না।”
“খারাপ শোনাবে না?”
“কেন, শিস তো তুমি ভালই দাও। আগে তো শিস দিয়ে বেশ পায়রা ওড়াতে।”
‘দূর পাগল! যখন সংসারী ছিলাম, তখন কত কী করেছি। এখন আর ওসব মানায়?”
“খুব মানায়। কেউ শুনছে না, দাও দেখি একটু শিস।”
নন্দবাবু আবার হার মানলেন। শিস দিতে গিয়ে দেখলেন, শব্দ হচ্ছে না তো!
একটু পরেই অবশ্য ভুল ভাঙল। হেলমেট পরা বলে বাইরের শব্দ আদপেই তাঁর কানে আসছে না। হেলমেটটা একটু তুলতেই তিনি শুনতে পেলেন, তার ঠোঁটে চমৎকার সুরেলা শিস বাজছে।
বেলতলাটা বেশ অন্ধকার! চারদিকে ঝোঁপঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। বাঁ ধারে শাঁখচুন্নির জলা। তার ওপাশে একটা মস্ত পোড়ো বাড়ি। না, একে পোড়ো বাড়ি বলার চেয়ে ধ্বংসাবশেষ বলাই ভাল। এক সময়ে এক নীলকর সাহেব মস্ত প্রাসাদ বানিয়েছিল আমোদ-ফুর্তির জন্য। সেই বাড়ির এখন ওই দশা। বিস্তর মানুষ ওখানে গুপ্তধন খুঁজতে গেছে। ভূতের বাড়ি বলেও একসময়ে অখ্যাতি ছিল। শীতকালে এক সাধু এসে প্রায়ই ওখানে আস্তানা গাড়ত। কিছুদিন চোর ডাকাতদেরও ডেরা হয়েছিল বাড়িটা। এখন আর কেউই ওখানে যায় না। চারদিকে এক ধরনের কাঁটাগাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল হয়েছে। নন্দবাবু এবং তার ভুতুড়ে ক্লাবের সদস্যরা ও বাড়িতে অনেকবার ভূত খুঁজতে হানা দিয়েছেন। কিন্তু ওবাড়ির ভূতেরা দেখা দেয়নি।
শ্যামবাবু বলেছিলেন, ভূত পুরনো হয়ে গেলে সেয়ানা হয়ে ওঠে। সহজে দেখা দেয় না।
রাধাগোবিন্দবাবু ভূতের ব্যাপারে খুবই বিশেষজ্ঞ লোক। থিওসফিক্যালি সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ভূত দেখেছেন বহুবার। শ্যামবাবুর কথায় তিনিও সায় দিয়ে বললেন, “ওই হয়েছে মুশকিল, পুরনো ভূতরা সহজে দেখা দিতে চায় না। নতুন যারা ভূত হয়েছে, তারা পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারে না কিনা, তাই হকেনকে দেখা দেয়।”
ফটিকাবু কখনও ভূত দ্যাখেননি, তবে ভূতের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। ভূত দেখার জন্য তিনি অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন। পোডড়া বাড়ির সন্ধান পেলেই গিয়ে হাজির হন। শ্মশানে কারখানায় নিশুত রাতে গিয়ে বসে থাকেন। এমন কী, ভূতের দেখা পেলে মা কালীকে জোড়া পাঁঠা দেবেন বলে মানতও করে রেখেছেন। তিনি একটু রেগে গিয়ে বললেন, “নতুন-পুরনো জানি না মশাই, আজ অবধি আপনারা একটা ভূতেরও ব্যবস্থা করতে পারলেন না। এমন চলতে থাকলে শেষ অবধি আমাকে আমার সেজো শালার কাছে একশো টাকা বাজি হারতে হবে। শুধু তা-ই নয়, নিজের কান মলে স্বীকার করতে হবে যে, তার কথাই ঠিক, ভূত বলে কিছু নেই।”
এ-কথায় সাত্যকিবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠে বললেন, “দেখা পাননি বলেই যে নেই, এটা তো যুক্তি হল না মশাই। আপনি দ্যাখেন না, কিন্তু আমি তো দিব্যি দেখি। এই পরশু দিন একটা মশার-আকৃতি ভূত মশারির মধ্যে ওড়াওড়ি করছিল। যতবার তালি দিয়ে মারতে যাই, ততবার ফশকায়। শেষ অবধি সেটা নাকের ডগায় এসে খুব যখন নাচানাচি করতে লাগল, তখন ভাল করে দেখলুম, মশা নয় একরত্তি একটা ভূত।”
ফটিকবাবু খ্যাক করে উঠে বললেন, “মানুষ মরে যদি ভূত হতে পারে, তো মশা মরেই বা হবে না কেন? আমি তো গোরুর ভূত, গণ্ডারের ভূত, গাছের ভূতও দেখেছি।”
ফটিকবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমার মেজো শালাকে এসব কথা বললে হা হা করে হেসে উঠবে যে।”
নন্দবাবু বেলতলায় দাঁড়িয়ে হেলমেটের কাঁচের স্বচ্ছ ঢাকার ভিতর দিয়ে অন্ধকার ধ্বংস্তূপের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। নিজের কাছে স্বীকার করতে তার লজ্জা নেই যে, আজ অবধি তিনি জলজ্যান্ত ভূত দেখতে পাননি। ভূতের আভাস অবশ্য পেয়েছেন। ভূত-ভূত অনুভূতিও হয়েছে, কিন্তু চোখের সামনে একেবারে স্পষ্ট দেখা আর হল কই?
ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যেই পা বাড়িয়েছেন, অমনি ধড়াম্ করে মাথার ওপর কী যেন একটা এসে পড়ল।
নন্দবাবু ভীষণ চমকে গিয়েছিলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আর তাজ্জবের কথা, নন্দবাবু ভারি চমৎকার সুরেলা একটা গান শুনতে পেলেন।
হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নন্দবাবু নিচু হয়ে দেখলেন, একটা পাকা বেল পায়ের কাছে পড়ে আছে। গাছ থেকে সদ্য ঘেঁড়া। মাথায় হেলমেট না থাকলে এই বেল তার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারত।
বেলটা কুড়িয়ে নিয়ে নন্দবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। গানটা কোথা থেকে আসছে? হেলমেটের মধ্যে তো বাইরের শব্দ ঢোকে না। তবে এটা ঢুকছে কী করে?