নন্দবাবুর সন্দেহ হল, দুলালবাবুর মাথার একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। এরকম হতেই পারে। নন্দবাবু সারা জীবন কেবল আঁক কষে গেছেন আর ঝুড়ি ঝুড়ি বিজ্ঞানের বই পড়ে গেছেন। অত বই পড়লে আর আঁক কষলে মাথা খারাপ হতেই পারে।
নন্দবাবু দুঃখিতভাবে জিব দিয়ে একটু চুকচুক শব্দ করে বললেন, “আহা।” দুলালবাবু এবারও ভ্রূ কুঁচকে নন্দবাবুর দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, “তা হলে কিনছ?”
নন্দবাবু মাথা চুলকে বললেন, “আমার তো নাম একটা আছে স্যার। একটা থাকতে আর একটা নাম কেনা কি উচিত?”
“তোমার নামটা যেন কী বললে!”
“আজ্ঞে নন্দদুলাল রায়।”
নাক কুঁচকে দুলালবাবু বললেন, “বাজে নাম। বিশ্রী নাম। পচা নাম। দুলাল সেন নামটা কত সুন্দর। তোমাকে বেশ মানাবেও হে। শস্তায় দিচ্ছি।”
নন্দবাবু সাধারণত কারও সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করেন না। তাতে মনটা লঘু হয়ে যায়। তবু এখন কেমন যেন একটু রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। বললেন, “আজ্ঞে শস্তা কোথায়? বেজায় আক্রা। প্রতি অক্ষর দশ পয়সা দরে পাওয়া যায়।”
দুলালবাবু হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “বলো কী? নরহরি যে বলল, অক্ষর একটাকা করে!”
“নরহরি কে স্যার?”
“সে আমার শাকরেদ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”
“কিসের শাকরেদ?”
“আমরা চুরি করতে বেরিয়েছি। খুব ভাল কাজ। সোজাও বটে।”
নন্দবাবু চোখ গোল করে বললেন, “চুরি!”
দুলালবাবু একগাল হেসে বললেন, “খুব সোজা কাজ। লোকের বাড়ি ঢুকে সব জিনিসপত্র চুপিচুপি সরিয়ে ফেলতে হয়। সেগুলো নরহরিই বেচে পয়সা এনে দেবে। তুমিও আমাদের সঙ্গে নেমে পড়ো কাজে। চুরি করলে বুদ্ধি বাড়ে, সাহস বাড়ে, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বাড়ে, চোখ কান-নাক সব সজাগ হয়। চুরির মতো জিনিস নেই।”
“বলেন কী স্যার? এ যে ভূতের মুখে রাম নাম।”
“তার মানে কী?”
“আপনি যে খুবই সাধু লোক ছিলেন। পঁচিশ বছর আগে কার কাছ থেকে যেন একটা পোস্টকার্ড ধার করে বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন, পঁচিশ বছর ধরে সেই পোস্টকার্ডের জন্য আপনার মানসিক যন্ত্রণা হত। পরে সেই লোকটার ছেলেকে খুঁজে বের করে একটা পোস্টকার্ডের ধার শোধ করেছিলেন! এ গল্প আপনি নিজেই আমাদের বলেছিলেন।”
দুলালবাবু দ্রুতবেগে জমাট পায়েস খেতে-খেতে ভারি আরাম বোধ করতে করতে বললেন, “পোস্টকার্ড! সেটা কী জিনিস বলো তো!”
নন্দবাবু খুবই হতাশ হয়ে দুলালবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন।
দুলালবাবু পায়েসের বাটি শেষ করে একটা ঢেকুর তুলে বললেন, “বাঃ, দিব্যি খাওয়া হল। এবার কাজ।”
“কী কাজ স্যার?”
“বাসনপত্রগুলো সব চুরি করতে হবে। আর গয়নাগাঁটিও। চলো তো ছোঁকরা, আমার সঙ্গে একটু হাত লাগাবে। নরহরি বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।”
নন্দবাবু হাসবেন কি কাঁদবেন তা বুঝতে পারলেন না। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। দুলাল সেন তাঁর চোখের সামনেই বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে পাঁজা করে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, “এগুলো চালান করে দিয়েই ফের আসছি এবাড়িতে দেখছি মেলাই জিনিস।”
দুলালবাবু খোলা জানালাটার কাছে এসে আহ্বাদের গলায় ডাকলেন, “নরহরি।”
সঙ্গে সঙ্গে জানলায় পাঁচুর ছায়া উদয় হল।
“এই যে ধরো। আরও জিনিস আছে।”
পাঁচু বাসনগুলো নিয়ে খুশি হয়ে বলল, “বড় সময় নিচ্ছেন যে পাঁচুবাবু। আরও একটু তাড়াতাড়ি করলে হয় না?”
দুলালবাবু হেসে বললেন, “খাচ্ছিলুম তো। বেশ খাওয়া হল। তাও তাড়াতাড়িই হত, একটা লোক এসে খামোখা নানা কথা জুড়ে দিল।”
আঁতকে উঠে পাঁচু বলল, “লোক! বলেন কী! তা হলে তো ধরা পড়ে গেছেন।”
“আরে না। তাকেও দলে ভিড়িয়েছি। সে এখন গয়নাগাঁটি নিয়ে আসছে।”
পাঁচু অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থেকে বলল, “কাজটা ঠিক করেননি পাঁচুবাবু। চুরির সময় অন্যদিকে মন দিতে নেই।”
দুলালবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “আচ্ছা, এবার মন দিয়েই চুরি করছি।”
পাঁচু বাসনগুলো নিয়ে গামছায় পোঁটলা বেঁধে ফেলল। তার মনে হল, এবারে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। লোকটা পাগল। ধরা পড়তে আর দেরি নেই। যা বাসনপত্র পেয়েছে পাঁচু তা বেচলে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা হেসেখেলে হয়ে যাবে। বেশি লোভ করা ভাল নয়।
পাঁচু বাসনের পোঁটলাটা পিঠে ফেলে রওনা দিল।
আর হঠাৎ দুটো লোহার মতো হাত এসে পিছন থেকে জাপটে ধরল তাকে।
.
আচমকা ধরা পড়ে পাঁচু আঁতকে উঠেছিল ঠিকই, তবে বহুদিনের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ফলে ঘাবড়ে গেল না। চেঁচামেচিও করে উঠল না। শুধু বজ্র আঁটুনিতে ‘কোঁক, কোঁক’ করে কয়েকটা শব্দ বেরোল মুখ দিয়ে। পাঁচু খুব বেকায়দায় পড়ছে। বুঝতে পেরে অমায়িক হেসে মোলায়েম গলায় বলল, “কে রে তুই দাদুভাই, অমন করে কি ধরতে আছে রে? বুড়ো হয়েছি না? তার ওপর এই দ্যাখ দাদুভাই, তোর ঠাকুমা একগাদা বাসন ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলল, যাও, বেয়াইবাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। তা মাইল তিনেক পথ হেঁটে এই একটু জিরেন নেব বলে। ভাবছিলাম।”
পিছন থেকে যে সাপটে ধরে আছে সে এবার ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “তুমি একটা জোচ্চর!”
পাঁচু জিভ কেটে বলল, “ওকথা বলবেন না বাবুমশাই। এই ভোরবেলায় দেবতারা সব বেড়াতে বেরোন কিনা। শুনে ফেলবেন। আর শুনলেই চিত্তির। সোজা স্বর্গে ফিরে গিয়ে আমার পুণ্যির খাতে যা জমা হয়েছিল সব ঢ্যাঁড়া মেরে দেবেন। এই ভোরবেলাটায় তাই পাপ কথা বলতে নেনই। পাপ কাজও করতে নেই।”