নন্দবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেল, “তোমরা খাওগে। আমার খাওয়া ঘুচে গেছে।”
‘মা-ঠাকরোন তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, বলেছেন নন্দটাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আয়। উপোস থেকে থেকে ছেলেটা আমার আধখানা হয়ে গেল।”
নন্দবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আজ আমার একাদশী রাখালদা। বিরক্ত কোরো না।”
“আরে একাদশী তো সারা বছরই আছে। উপোস করতে চাইলে শুধু একাদশী কেন, অমাবস্যা, পূর্ণিমা অনেক পাবে। কিন্তু এমন খ্যাঁটখানা তো আর নিত্যি হবে না। আজ তিতলির জন্মদিন বলে কথা!”
নন্দবাবু শুকনো মুখে মাথা নাড়লেন, “ও হয় না, রাখালদা। লোভ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
রাখাল তার পাকা চুলে ভর্তি মাথাটা নেড়ে বলল, “নাঃ, তোমার মাথাটাই দেখছি গেছে। এই বয়েসেই যদি তুমি এত কিছু ত্যাগ করে বসে থাকো, তবে বুড়ো বয়সে ত্যাগ করার যে আর কিছুই থাকবে না। আমাদের দেশে এক হতুকিবাবা ছিল। সব ছাড়তে ছাড়তে শেষে হকিতে এসে ঠেকেছিল। দিনান্তে একখানা হত্ত্বকি চিবিয়ে জল খেত। সারা দিনমানে আর কিছু নয়। তারপর একদিন বিশ্বনাথ দর্শন করতে গিয়ে সেই হকিও ছেড়ে দিল। পুঁকতে ধুকতে মরতে বসেছিল। তারপর এক ঘোড়েল লোক গিয়ে তার কানে কানে বলল, আরে, সব ছেড়েছ, কিন্তু কেক-বিস্কুট-পাউরুটি তো আর ছাড়োনি। ওগুলো খেয়ে প্রাণটা বাঁচাও। তা হকিবাবার তখন এতই খিদে যে, কথাটা লুফে নিল। কেক-বিস্কুট খেয়ে প্রাণটা বলি হকিবাবার। আমি তাই বলি, ওরকম দুর্দশা হওয়ার আগেই নিজেকে সামলাও।”
নন্দবাবু পাশ ফিরে শুয়ে বললেন, “তুমি এখন যাও রাখালদা। আমার সাঙ্গু ভেজানো আছে।”
রাখাল কটমট করে নন্দবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “ভাল জিনিসকে অবহেলা করলে কী হয় জানো? মা লক্ষ্মীর শাপ লাগে আত্মাকে কষ্ট দিতে নেই।”
নন্দবাবু একটু হেসে বললেন, “তুমি আত্মার তত্ত্বই জানো না। আত্মার কখনও খিদে পায় না আত্মার খাওয়া নেই, ঘুম নেই, তেষ্টা নেই।”
“বটে! তবে আত্মাটা আছে কী করে?”
“সেটাই তো রহস্য।”
“তবে থাকো তোমার রহস্য নিয়ে শুঁটকি মেরে।”
রাখাল রাগ করে চলে গেল।
রাখাল চলে যাওয়ার পর একা ঘরে নন্দবাবু চোখ বুজে প্রাণপণে মন থেকে বিরিয়ানি, চপ, রোস্ট ইত্যাদির চিন্তা তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এমন সময় দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। নন্দবাবু চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন। ঘরে কেউ নেই।
নন্দবাবু আবার চোখ বুজলেন।
কে যেন বলে উঠল, “কাজটা খারাপ হল হে নন্দবাবু।”
নন্দবাবু ফের চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন। কেউ নেই।
হঠাৎ নন্দবাবু বুঝতে পারলেন, কথা বলছে আর কেউ নয়। তাঁর মন।
মন বলে উঠল, “কাজটা খুব বিবেচকের মতো করলে না হে নন্দলাল। আর একটু ভেবেচিন্তে দেখলে পারতে।”
নন্দবাবু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “বলিস কী রে মন? একাদশীতে বিরিয়ানি?”
“নন্দবাবু, তোমার সাধন-ভজন সবই ভস্মে ঘি ঢালা হল।”
“তার মানে কী রে মন?”
“বলছিলাম, যে-সাধক সাধন-ভজন করতে করতে ওপরে উঠে গেছে, তার কাছে আর কি খাদ্যাখাদ্য ভেদ থাকে? তার কাছে মুরগিও যা, গঙ্গাজলও তাই।”
“ওসব বলিসনি রে মন। তোর লোভ তোকে ওসব বলাচ্ছে।”
“আমি বলি কি নন্দবাবু, শাস্ত্রে একটা কথা আছে, তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। কথাটার মানে জানো?”
“খুব জানি। ত্যাগ করে ভোগ করো।”
“তবেই বোঝো, কেমন দামি কথা। যা ত্যাগ করবে, তা ভোগ করতে আর বাধা কিসে? ছেড়েই যখন দিয়েছ তখন আর খেতে বাধা কিসের?”
“ওরে লোভী মন, তুই আর আমাকে কুপথে নিস না, ত্যাগের জলে নিজেকে ধুয়ে নে। পরিচ্ছন্ন হ।”
“মেলা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো নন্দবাবু, ভাল রান্নাও একটা শিল্পকর্ম, বুঝলে? তাকে অবহেলা করলে শিল্পকেই অপমান করা হয়।”
“অনেক তো খেয়েছিস রে মন, আর কেন? এবার ওপরে ওঠ। ওপরে ওঠ।”
“তা উঠতে রাজি আছি। তবে দোতলা অবধি। তুমিও গা তোলো হে নন্দবাবু। রান্নাঘরটা একেবারে ম-ম করছে গন্ধে। ওই সাগুর গোলা যদি আজও তোমাকে গিলতে হয় তবে বরং ওর সঙ্গে একটু বিষ মিশিয়ে নাও। বৈরাগ্যের একেবারে চরম হয়ে যাবে।”
নন্দবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মন, তুই হচ্ছিস বিষাক্ত সাপের মতো। তোকে ঝাঁপিতে বন্ধ না করলে আর উপায় নেই।”
“বটে! আমাকে ঝাঁপিতে ভরবে? অত সোজা নয় হে নন্দবাবু। তোমার চেয়ে ঢের বড় বড় লায়েককে দেখেছি।”
নন্দবাবু এবার বেশ রেগে গিয়ে ধমক দিলেন, “চুপ কর বলছি। নইলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”
“খারাপ আর এর চেয়ে কী হবে হে নন্দবাবু? ওপরে সবাই বসে কোমরের কষি খুলে ভালমন্দ খাচ্ছে, আর তুমি একতলার ঘরে বসে সাগুদানা আর পাকা কলা গিলছ, এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে হে?”
নন্দবাবু বুঝলেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। খিদে বেশ চাগাড় দিচ্ছে। নন্দবাবু উঠে পড়লেন এবং সাগু মেখে খেতে বসে গেলেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সাগু তাঁর গলা দিয়ে নামল না। দু-এক গ্লাস খাওয়ার পরই বিস্বাদে মন ভরে গেল। নন্দবাবু ঢকঢক করে পেট ভরে জল খেয়ে নিলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু মধ্যরাতে নন্দবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন, কে যেন কাঁদছে।
“কে কাঁদে?” বলে নন্দবাবু উঠে বসলেন।
কে যেন জবাব দিল, “তোমার পেট হে।”
নন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “পেট! পেট কেন কাঁদবে?”
“গরিব-দুঃখীরা কাঁদে কেন নন্দবাবু? গরিব বলেই তো কাঁদে। তোমার পেটটাকে যে তুমি গরিব করে রেখেছ, বেচারার যে কিছুই করার নেই। তাই কাঁদছে।”