এই দৃশ্য দেখে বাইরে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। শুধু মন্টুই ভীষণ বেজার হয়ে পড়ল। কারণ স্কুলে সে হল হাই জাম্পের চ্যাম্পিয়ান। এই তো মোটে দু’দিন আগে স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টসে সাড়ে পাঁচ ফুটের ওপর লাফিয়ে ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে। কিন্তু দুলালবাবুর মতো বৃদ্ধ মানুষকে দাঁড়ানো অবস্থায় যতটা লাফিয়ে উঠতে দেখল, তাতে তার চোখ ট্যারা। তার হিসেবমতো দুলাল-স্যার কম করেও পৌনে ছ’ফুট লাফিয়েছেন। দুলাল স্যার যদি চেষ্টা করেন
তা হলে তো অনায়াসে সাড়ে ছয় থেকে সাত ফুট লাফাতে পারবেন।
লালু মন্টুকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, “মন্টু দুলাল স্যারের কাছে তোর এখনও অনেক কিছু শেখার আছে।”
মন্টু গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁ।”
দুলালবাবুও একটা লাফ দিয়েই বুঝতে পারলেন যে, তিনি বেশ ভালই লাফাতে পারেন। তাঁর হাঁটু ঝনঝন করল না, কোমর কনকন করল না, মাথা বনবন করল না। নিজের এই লাফ দেখে তিনি নিজেই বেশ খুশি হলেন। এবং আর একবার লাফাবেন কি না ভাবতে লাগলেন। আসলে লাফ দিতে গিয়ে তিনি কেন লাফিয়েছেন সেটাই বেবাক ভুলে গেছেন। তিনি যে ভয় পেয়েছেন সেটাও তাঁর মনে পড়ল না। তিনি মালকোঁচা মেরে দুটো বৈঠকি দিয়ে ফের লাফানোর তোড়জোড় করতে লাগলেন।
মন্টু মুখ চুন করে বলল, “এবার যদি স্যার লাফান তা হলে খুব খারাপ হবে।”
লালু পালটা প্রশ্ন করল, “কী খারাপ হবে?”
মন্টু বলল, “বুড়ো বয়তে এত লাফঝাঁপ কি ভাল? কোমরে চোট লাগতে পারে। আমাদের উচিত স্যারের লাফ বন্ধ করা।”
লালু মাথা নেড়ে বলল, “মোটেই সেটা উচিত হবে না। দুলাল স্যারের যা এলেম দেখছি, তাতে ওঁকেই এখন এ-জেলার চ্যাম্পিয়ান বলতে হয়। তুই তো ওঁর কাছে নস্যি।”
ল্যাবরেটরির ভিতরে দুলাল স্যার শেষ অবধি দ্বিতীয় লাফটা দিতে পারলেন না। সিলিন্ডারের মুখে একটা বেলুন পরানো ছিল। সেটা বেড়ে বেড়ে বিশাল আকৃতি ধারণ করে অবশেষে দুম করে ফাটল। আর ছেঁড়া রবার ছিটকে এসে লাগল দুলাল-স্যারের নাকে।
ঘটনাটা কী ঘটেছে তা দুলাল স্যার বুঝতে পারলেন না। কিন্তু নাকে ভুতুড়ে ঘুসির মতো একটা ঘা খেয়েই তিনি ফের “বাবা গো” বলে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লেন।
এই দৃশ্য দেখে ভুতো আর থাকতে পারল না। জানলার পাল্লা একটানে খুলে সে ভিতরে ঢুকল। তারপর দুলাল-স্যারকে তুলে একটা চেয়ারে বসিয়ে একটু তুলো ভিজিয়ে নাকে ধরল।
দুলাল-স্যার মিটমিট করে চেয়ে দেখলেন, একগাদা বাচ্চা তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। মুখগুলো এবার তাঁর খুবই চেনা-চেনা ঠেকল।
মণ্ট খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, “স্যার, আপনার কিন্তু লাফালাফি করা উচিত নয়।”
দুলাল স্যার শুনলেন, ‘হারাকিরি করা উচিত হয়।’
তিনি সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “খুব খারাপ। হারাকিরি করা খুব খারাপ।”
এতগুলো বাচ্চাকে পেয়ে দুলাল স্যার খুবই খুশি হয়ে উঠে পড়লেন। সবাই চেঁচাতে লাগল, “স্যার আমরা বেলুন নেব।”
“বেগুন খাবে? তা এই অসময়ে বেগুন কোথায় পাব? তার চেয়ে বরং একটা করে বেলুন নাও সবাই।”
বেলুন পেয়ে বাচ্চারা দারুণ খুশি হয়ে চেঁচামেচি করতে লাগল, এই, আমারটা সবচেয়ে বড়। ইঃ, আমারটা বলে কত সুন্দর। উঃ, তোরটা তো কেলেমার্কা, আমারটা কেমন লাল টুকটুকে। তোরটা তো লাউয়ের মতো, আমারটা কী সুন্দর একটা বলের মতো!
বাচ্চাদের মধ্যে যারা একটু বড় তারা বেলুন নিয়ে মাতামাতি না করে ল্যাবরেটরির বিভিন্ন জিনিস ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। কেউ বকযন্ত্র নাড়াচাড়া করতে লাগল, কেউ বা বুনসেন বানার জ্বালানোর চেষ্টা করতে লাগল, কেউ বিভিন্ন শিশি থেকে নানারকম কেমিক্যাল একটা টেস্ট-টিউবে ঢেলে মেশাতে লাগল।
গদাই আর নিমাই বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র। তারা নানারকম-এক্সপেরিমেন্ট করতে লেগে গেল।
মন্টু তার টেস্ট-টিউবে রাজ্যের কেমিক্যাল ঢেলে বুনসেন বানারে চাপিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “এইবার আমি এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করব না যে, পৃথিবীতে হই-চই পড়ে যাবে।”
জিনিসটা বুনসেন বানারে চাপানোর পরই একটা কটু গন্ধ ছাড়তে শুরু করল। বাচ্চার সবাই নাকে চাপা দিয়ে ‘ইঃ, এঃ” করতে লাগল।
কিছুক্ষণ বাদে একটা নীলাভ ধোঁয়া গলগল করে বেরোতে লাগল টেস্ট-টিউব থেকে। সারা ঘর নীল ধোঁয়ায় ভরে যেতে লাগল।
ভুতো চেঁচিয়ে বলল, “পালাও! পালাও!” বাচ্চারা দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালাতে লাগল।
হঠাৎ দুম শব্দ করে টেস্ট টিউবটা ফেটে চারদিকে একটা নীল আলো চমকে উঠল।
দুলাল স্যার অনেকদিন হল পৃথিবীর কোনও শব্দই ভাল শুনতে পান না। কিন্তু টেস্ট টিউব ফাটবার আওয়াজটা তিনি আজ পরিষ্কার শুনতে পেলেন। শব্দটা এত তীক্ষ্ণ যে, তাঁর কান তো খুলে গেলই, ফের শব্দের চোটে তালাও লেগে গেল।
চারদিকে নীল ধোঁয়া আর কটু গন্ধটা টের পেয়ে দুলাল স্যার সচকিত হলেন। তাঁর আর একবার লাফ দেওয়ার ইচ্ছে হল। এবারও অবশ্য ভয়ে। কিন্তু দিতে পারলেন না!
কেমন যেন অবসন্ন ঘুম-ঘুম একটা ভাব ভর করল শরীরে। তিনি ধীরে ধীরে মেঝের ওপর বসে পড়লেন। তারপর হাই তুলতে লাগলেন। তারপর ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন মেঝের ওপর।
বাচ্চারা সবাই ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালাল।
শুধু ভুতো, মন্টু আর গদাই একটু দুরে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখতে লাগল।