হঠাৎ লালু লাফিয়ে উঠে বলল, “চল তো দেখে আসি। দুলাল স্যার ভীষণ ভালমানুষ। আমরা বললেই ঢুকতে দেবেন।”
একথায় সবাই হইহই করে উঠে পড়ল।
ধ্যান ভেঙে গেলে ভুতোও বাচ্চাদের মতোই হয়ে যায়। তখন আর সে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা ভাবেও না, বলেও না। বাচ্চাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভুতো চোখ চাইল। তার ধ্যানটা কেটে গেছে।
“ভুতোদা, তুমিও চলো।”
“চলো।”
টিকলি সাবধান করে দিয়ে বলল, “কিন্তু পা টিপেটিপে, দাদু টের পেলে আস্ত রাখবে না।”
সামনে ভুতো, পিছনে সারবন্দী ছেলেমেয়েরা খুব সাবধানে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বাগানে নেমে পড়ল। সামনে ঝোঁপঝাড়, ঘাসজমি, খানাখন্দ। ল্যাবরেটরিটা বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে।
ল্যাবরেটরির কাছে এসে ভুতো বলল, “দাঁড়াও, আগে জানলা দিয়ে ভিতরে কী হচ্ছে দেখে নিই।”
বাচ্চারা ছড়িয়ে পড়ে এক-একটা জানলা দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল।
কাজু টিকলিকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “ওই দ্যাখ, দুলাল স্যার বেলুন ফোলাচ্ছেন।
“বেলুন?” বলে টিকলি বড় বড় চোখে চেয়ে দেখল।
বাস্তবিকই দেখা গেল, দুলাল সেন নিবিষ্ট মনে একটা সিলিন্ডারের মুখে একটার-পর-একটা বেলুন লাগিয়ে ফুলিয়ে তুলছেন। তারপর সেগুলোর মুখে সুতো বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছেন। বেলুনগুলো গিয়ে সিলিং-এ ঠেকে জমা হচ্ছে।
.
এই ল্যাবরেটরিতে কেন তাঁকে আনা হয়েছে এবং এখানে তাঁকে কী কাজ করতে হবে তা দুলাল সেন খুব ভাল বুঝতে পারেননি। ভুবন রায় তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা শুনিয়েছেন। কিন্তু শোনালে কী হবে, কানের গুণে দুলাল সেন তাঁর বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেননি।
ভুবন রায় বললেন, “নিত্যনতুন আবিষ্কার করতে হবে।”
দুলাল সেন শুনলেন, “নিত্যানন্দকে ঘর পরিষ্কার করতে হবে।”
ভুবন রায় বললেন, “বিজ্ঞান নিয়েই পড়ে থাকুন, বিজ্ঞানের বান ডাকিয়ে দিন। দুলাল সেন শুনলেন, “শিকনি ঝেড়ে মরে থাকুন, শিকদারকে চাঁদে পাঠিয়ে দিন।”
কথাগুলোর অর্থ হয় না। তবে দুলাল সেন এটা টের পান যে, কানে তিনি কিছু খাটো। তাই যা শোনেন তাই তিনি বিশ্বাস করেন না। ভেবে ভেবে অর্থ বার করার চেষ্টা করেন। এই যেমন ঘর পরিষ্কার করতে হবে’ কথাটা, এটাকে নিয়ে অনেক ভেবে বুঝলেন, এখানে নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরি ঝটপাট দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। বিশেষ করে নিত্যানন্দ নামে কাউকে তিনি চেনেনও না। শিকনি ঝেড়ে মরে থাকুন, শিকদারকে চাঁদে পাঠিয়ে দিন’- এ কথাটারও তেমন কোনও অর্থ দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু ভাবতে ভাবতে একটা অর্থ তিনি ঠিকই বের করে ফেলবেন।
তবে ভুবন রায়ের লোকজন গিয়ে যখন তাঁকে তাঁর বাসা থেকে একরকম তুলে আনল, তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবে তিনি এতে খুশিই হয়েছিলেন। বাড়িওয়ালা কিছুদিন যাবৎ তাঁর ওপর খুব হামলা করছিল।
কিন্তু যেখানে এনে তাঁকে ফেলা হল, সে জায়গাটা দেখে তিনি খুব অবাক। এ যে এক ল্যাবরেটরি! বিশাল ঘর। নানা যন্ত্রপাতি। তারই এক কোণে একটা চৌকি পাতা। একধারে উনুন আছে। দিব্যি থাকার জায়গা। দুলালবাবু খুশিই হলেন ব্যবস্থা দেখে। রাঁধেন বাড়েন খান ঘুমোন। কোনও চিন্তা নেই। তবে মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয়, নিত্যানন্দকে দিয়ে কি ঘর পরিষ্কার করানো দরকার? শিকনি ঝেড়ে মরে থাকা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? আর শিকদারকে চাঁদে পাঠানোর বন্দোবস্তও তো কিছু করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
সেদিন সকালে ভুবন রায় ল্যাবরেটরিতে এসে অনেকক্ষণ ধরে একটা কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করলেন। দুলাল সেন মিটমিট করে চেয়ে দেখলেন। তারপর ভুবন রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, বেগুনের মধ্যে হরমোন ইনজেকশন করলে কী হয়?”
দুলালবাবু শুনলেন, “বেলুনের মধ্যে গণ্ডগোল পাকিয়ে দিলে ঘি হয়?”
কথাটা দুলাল সেন স্বীকার করে নেবেন কি না তা মাথা চুলকে অনেকক্ষণ ভাবলেন। ভুবন রায় তাঁর আশ্রয়দাতা, কাজেই উনি কিছু জিজ্ঞেস করলে আন্দাজে একটা জবাব দিতেই হয়।
দুলাল সেন মিনমিন করে বললেন, “হতেও পারে।”
কিন্তু তারপর থেকে আকাশ-পাতাল ভেবেও তিনি বুঝতে পারছেন না বেলুন থেকে কী করে ঘি হবে, আর বেলুনের মধ্যে গণ্ডগোলই বা পাকানো যায় কী ভাবে?
দুলালবাবু তবু বাজার থেকে একগাদা বেলুন কিনে আনলেন এবং তাদের মধ্যে নানারকম গণ্ডগোল পাকানোর কথা ভেবে দেখলেন। অবশেষে তাঁর মনে পড়ল, ছেলেবেলায় তাঁর খুব গ্যাস-বেলুন ওড়ানোর শখ ছিল। কিন্তু বড্ড গরিব ছিলেন বলে তাঁর বাবা গ্যাস-বেলুন কিনে দিতে পারেননি। এতকাল পরে এতগুলো বেলুন একসঙ্গে পেয়ে তাঁর খুব ইচ্ছে হল, গ্যাস-বেলুন ওড়াতে।
গ্যাসের অভাব নেই। মস্ত একটা সিলিন্ডার মজুত রয়েছে।
দুলালবাবু রাত্রিবেলা মহানন্দে বেলুনে গ্যাস ভরে-ভরে মুখ বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছিলেন আর সেগুলো গিয়ে সিলিঙে ঠেকে জমা হচ্ছিল।
“বাঃ, বাঃ, চমৎকার। বেলুনের মধ্যে দিব্যি গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠছে। এবার ঘি নিয়েই যা একটু মুশকিল…!”
হঠাৎ দুলালবাবুর চোখে পড়ল, কাঁচের শার্শির বাইরে সারি সারি মুখ। সবাই তাঁর দিকেই চেয়ে আছে।
আচমকা এই দৃশ্য দেখে ভিতু মানুষ দুলাল সেন ভয় খেয়ে “বাপ রে” বলে এমন একটা লাফ মারলেন যে, তিনিও প্রায় গ্যাস-বেলুনের মতোই সিলিঙে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছিলেন। অল্পের জন্য মাথাটা বেঁচে গেল।