“তারপর কী হল?”
“একদিন একটা কালোমতো রাগি পরি এসে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে? পৃথিবীর একটা ছেলেকে তোমরা কেন রেখেছ! যাও, ওকে রেখে এসো।’ ব্যস, সেইদিন পরিরা আমার চোখে পলক বুলিয়ে ঘুম পাড়াল। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি, একটা গাছতলায় শুয়ে আছি। সেখান থেকেই তো রামলাল-জ্যাঠামশাই আমাকে নিয়ে এলেন এ বাড়িতে। কিন্তু আমার মনে হয়, পরিরা এখনও আমাকে ভালবাসে। মাঝে-মাঝে আমি হঠাৎ শুনতে পাই, কারা যেন চুপিচুপি আড়াল থেকে আমাকে ডাকে, ভুতো! এই ভুতো! তোমার কি খিদে পেয়েছে? তোমার কি অসুখ করেছে? আমিও তখন তাদের কথার জবাব দিই। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার বালিশের পাশে একটা খেলনা পড়ে আছে হয়তো। কখনও হয়তো একবাক্স সন্দেশ। অসুখ করলে কে যেন আমাকে এসে হাওয়া করে, মাথায় জলপট্টি দেয়।”
ভুতোর পরির গল্প সবাই জানে। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে না।
ভুতোকে মোটেই পছন্দ করে না ছোট দাদু। ছোট দাদু হলেন ভুবন রায়ের সেজো ভাই ত্রিভুবন রায়। তিনি বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, অনেক মরা মানুষ বাঁচিয়েছেন বলে শোনা যায়।
সেবার ফটিকবাবুর মায়ের সন্ন্যাস-রোগ হল। ত্রিভুবনবাবু গিয়ে নাড়ী ধরে বললেন, “রাত কাটবে না। চারটে বেজে তেরো মিনিট উনিশ সেকেন্ডে মারা যাবেন।”
ভুতো কাছেই ছিল। ফশ করে বলে বসল, “বললেই হল? অ্যাকেসিস ওয়ান এম দাও না। বুড়ি একশো বছর বাঁচবে।”
ত্রিভুবন ভুলোকে ছাতাপেটা করতে উঠেছিলেন।
কিন্তু ফটিকবাবু ভুতোর পরির গল্প বিশ্বাস করতেন। তিনি অ্যাকেসিস ওয়ান এম এনে খাওয়ালেন। আর ফটিকবাবুর মা সকালবেলায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে চান-টান করে ঠাকুরপুজোয় বসে গেলেন। কে বলবে যে, তাঁর শক্ত অসুখ হয়েছিল।
এই ঘটনায় ত্রিভুবনবাবুর কিছু অখ্যাতি হল।
এরপর নরেনবাবুর বাবার হল কলেরা। ত্রিভুবন ডাক পেয়ে দেখতে গেছেন, সঙ্গে ওষুধের বাক্স নিয়ে ভুতো। ত্রিভুবন যে ওষুধটা দিতে গেলেন সেটা দেখে ভুতো চোখ কপালে তুলে বলল, “ও কী দিচ্ছ? ও খেলেই রুগির চোখ উলটে যাবে।”
ভুতকে পেল্লায় একটা ধমক দিয়ে ত্রিভুবন সেই ওষুধই দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে নরেনবাবুর বাবা চোখ উলটে গোঁ-গোঁ করতে লাগলেন। যায়যায় অবস্থা।
ভুতো তাড়াতাড়ি বাক্স থেকে আর একটা শিশি বের করে দু’ফোঁটা খাইয়ে দিল। আর রুগি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। পরদিন থেকে একেবারে চাঙ্গা।
সেই থেকে ভূতোর ওপর ত্রিভুবন হাড়ে হাড়ে চটা।
শুধু ত্রিভুবনই নন, ভুতোর ওপর চটা আরও অনেকেই, কিন্তু সে কথা পরে হবে।
এ বাড়ির ছেলেপুলেরা ভুতোকে পেয়ে দারুণ খুশি। ভুতো চমৎকার ঘুড়ি লাটাই বানাতে পারে, পাখির খাঁচা বানাতে পারে, গাছের মগডালে উঠে ফলপাকুড় পাড়তে পারে। চমৎকার গল্প বলতে পারে, বাঁশি বাজাতে পারে, আরও অনেক কিছু পারে। কিন্তু তার যেটা সবচেয়ে বড় গুণ তা হল, পরিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ।
মাঝে-মাঝে যখন তার মাথায় পরি ভর করে, তখন সে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে। তার চাউনিটা অন্যরকম হয়ে যায়। চেহারাটাও যেন পালটে যায় তখন।
রায়বাড়ির একতলায় কোণের দিকে পড়ার ঘর। সন্ধেবেলা সেখানে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে পড়তে বসে। অনাদি-মাস্টার পড়াতে আসেন। দুর্দান্ত রাগি আর রাশভারী অনাদিবাবুকে শুধু ছাত্ররাই নয়, ছাত্রদের বাবারাও ভয় পান।
আজ অনাদিবাবু কোথায় শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে গেছেন। সুতরাং আজ ছুটি। পড়ার ঘরে বসে মন্টু, গদাই, লালু, হৈমন্তী, কাজু, টিকলি, নিমাই, সব কিছুক্ষণ গলা ছেড়ে পড়ার পরই ভুতোকে চেপে ধরল, “ভুতোদা, একটা গল্প বলো।”
ভুতো বই-খাতা সরিয়ে রেখে একগাল হেসে বলল, “গল্প শুনবে? কিন্তু দাঁড়াও, আমার মাথার মধ্যে কেমন একটা রিমঝিম হচ্ছে।”
সবাই চেঁচিয়ে উঠল, “পরি! পরি!”
ভুতো হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইঙ্গিত করল, তারপর চোখ বুজে বসে রইল।
হঠাৎ দেখা গেল ভুতোর মুখটা কেমন যেন স্বপ্ন-স্বপ্ন হয়ে যেতে লাগল। এমনিতে ভুতো দেখতে কালো আর রোগা! মুখোনা শুকনো আর লম্বামতো। কিন্তু এখন তার মুখ দিয়ে যেন একটা আলোর আভা বেরোতে লাগল।
সে বিড়বিড় করে বলল, “দাদামশাই ভূতের যন্তরটা তৈরি করে ভাল কাজ করেননি। অনেক ভোগাবে।”
লালু বলে উঠল, “ভূতের যন্ত্র? আরে, সেটা তো আমি নিজে চোখ রেখে দেখেছি, কিছু দেখা যায় না।”
ভুতো মাথা নেড়ে বলল, “এখনও দেখা যায় না বটে, কিন্তু একদিন দেখা যাবে, তখন বিপদ হবে। আর দুলাল সেনকে নিয়েও বিপদ হবে।”
লালু ফের বলল, “কিন্তু দুলাল সেন-স্যার তত ভাল লোক।”
ভুতো মাথা নেড়ে বলল, “ভাল বলেই তো বিপদ।”
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
গদাই বলল, “কিন্তু দুলাল সেন স্যার তো সেই কামারপাড়ায় থাকেন। তাঁকে নিয়ে আমাদের বিপদ কিসের?”
ভুত ফের মাথা নেড়ে বলল, “মোটেই কামারপাড়ায় থাকেন না। তিনি দাদামশাইয়ের ল্যাবরেটরিতে থানা গেড়েছেন।”
ল্যাবরেটরিটা বাচ্চাদের কাছে একটা দারুণ কৌতূহলের জায়গা। যেখানে নানারকম মজার কাণ্ডকারখানা হয় বলে তারা শুনেছে। কিন্তু তালা দেওয়া থাকে বলে তারা ঢুকতে পারে না। ভুবন রায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে, বাচ্চারা যেন খবার কেউ ওখানে না ঢোকে। সেখানে দুলাল সেন আছে শুনে বাচ্চারা ফের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।