মহাকাশযানের মাঝে একটা লাল আলো কিছুক্ষণ পর পর ঝলকানি দিতে থাকে। একটা চাপা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসে। পুরো মহাকাশযানটি থরথর করে এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে য়ুহার মনে হতে থাকে পুরো মহাকাশযানটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যতই সময় যেতে থাকে য়ুহার মনে হয় অদৃশ্য শক্তিটা বুঝি তাকে আরো জোরে চেপে ধরছে। তার মনে হতে থাকে সে বুঝি তার চোখের পর্দাটাও আর খুলতে পারবে না। মাথায় এক ধরনের ভোতা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে, চোখের ওপর একটা লাল পর্দা খেলা করতে থাকে। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, সে প্রবল এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করে। য়ুহার মনে হতে থাকে সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু যে কোনো মূল্যে সে জেগে থাকতে চায়। য়ুহা প্রচণ্ড গতির সেই বিস্ময়কর শুরুটুকু নিজের চোখে দেখতে চায়, নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে চায়। প্রাণপণে সে চোখ খোলা রেখে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, আমি অচেতন হব না। কিছুতেই অচেতন হব না। কিছুতেই হব না?
য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে। সে অনুভব করতে থাকে তার শরীরের মাংসপেশিতে ভোতা এক ধরনের যন্ত্রণা। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন টেনে তার মুখের মাংসপেশি পেছন দিকে সরিয়ে নিয়েছে, মুখ থেকে দাঁতগুলো বের হয়ে আসছে, চেষ্টা করেও সে সেটা বন্ধ করতে পারছে না। এটি একটি অভূতপূর্ব অনুভূতি। য়ুহা নিজেকে বোঝাল, পৃথিবীর খুব বেশি মানুষের এই অনুভূতিটি অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি। আমি নিঃসন্দেহে একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি য়ুহা এক সময় এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে অনেক কষ্ট করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে কিছু একটা দপদপ করছে, সে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এটি শেষ হবে। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য পাথরটি সরে যাবে, আবার সে উঠে বসতে পারবে।
য়ুহার কাছে যখন মনে হয় বুঝি অনন্তকাল কেটে গেছে তখন হঠাৎ করে মহাকাশযানের ত্বরণ কমে আসতে শুরু করে। য়ুহার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে তার সারা শরীর বুঝি পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে আসছে। যখন মিটিয়া এসে তার বেল্টটি চাপ দিয়ে খুলে তাকে বের করে আনল, তখন য়ুহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক ধন্যবাদ মিটিয়া, আমার মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর কখনো এই অদৃশ্য দানবের হাত থেকে মুক্তি পাব না!
মিটিয়া য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথমবার হিসেবে তুমি চিৎকার করেছ য়ুহা। তোমাকে নিয়ে আমাদের রীতিমত গর্ব হচ্ছে।
ধন্যবাদ মিটিয়া।
এরপরের ধাপে তুমি নিশ্চয়ই আরো ভালো করবে!
পরের ধাপ?
হ্যাঁ। এর পরের ধাপ!
য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, এর পরের ধাপ মানে কী?
মহাকাশযানটি ক্রমাগত তার গতিবেগ বাড়িয়ে চলে। একবারে তো করা যায় না, তাই এটাকে ধাপে ধাপে করতে হয়। প্রত্যেকবারই তার গতিবেগ আগের থেকে বাড়িয়ে তোলা হয়। মাঝে মাঝে আমরা বিরতি দিই, তখন দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিতে হয়। খাওয়া-দাওয়া করি।
য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আবার মহাকাশযানের গতি বাড়ানো হবে? আবার আমাকে মহাকাশযানের চেয়ারে বেল্ট দিয়ে বেঁধে বসতে হবে?
হ্যাঁ। মিটিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, একবার নয়, অনেকবার।
অনেকবার?
হ্যাঁ। প্রত্যেকবারই আগেরবার থেকে বেশি তীব্রতায় এবং বেশি সময় ধরে।
য়ুহা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তবে ভয় নেই-তুমি দেখবে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটায় তুমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ!
তার মানে আমার আর কষ্ট হবে না?
মিটিয়া য়ুহার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি সেটা বলিনি। কষ্ট যেটুকু হবার সেটা তো হবেই।
তাহলে?
কষ্ট সহ্য করা শিখে যাবে।
ঘণ্টা দুয়েক পর য়ুহা আবার আবিষ্কার করল, তাকে মহাকাশযানের আরামদায়ক চেয়ারটিতে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। বিশাল মহাকাশযানটি আবার ঝটকা দিয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। মহাকাশযানের ভেতর একটা লাল আলোর ঝলকানি দেখা যায়, য়ুহার মনে হতে থাকে তার বুকের ওপর একটা অদৃশ্য পাথর ধীরে ধীরে চেপে বসেছে। হব না। আমি অচেতন হব না। য়ুহা বিড়বিড় করে বলল, আমি কিছুতেই অচেতন হব না।
য়ুহা তার সমস্ত স্নায়ুকে শক্ত করে পাথরের মতো বসে থাকে। মনে হতে থাকে বুঝি অনন্তকাল কেটে যাচ্ছে।
০৬. মহাকাশযানের গতিবেগ বাড়িয়ে
ধাপে ধাপে মহাকাশযানের গতিবেগ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত গতিবেগে পৌঁছানোর পর মহাকাশযানের ভেতরের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলো। খাবার টেবিল ঘিরে কমান্ডের সবাই এসে বসেছে, ক্যাপ্টেন ব য়ুহার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, এই যে কবি য়ুহা তোমার অবস্থা কেমন?
ভালো।
তোমার খুব দুর্ভাগ্য যে তুমি একটা সামরিক মহাকাশযানে যাচ্ছ। সাধারণ যাত্রীদের মহাকাশযানে এত কষ্ট নেই।
কষ্ট ছাড়া যদি যাওয়া যায় তাহলে মিছি মিছি কষ্ট করা হয় কেন?
সময় বাঁচানোর জন্যে। প্রাথমিক গতিবেগ যত বাড়ানো যায় তত সময় বাঁচানো যায়। মহাকাশযানের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে সময়। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রাথমিক বেগটা বাড়িয়ে নিয়েছি।