এটা তোমার নামে ইস্যু করা হয়েছে। তুমি রাখতে পার।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, না, না, আমি রাখতে চাই না।
একটা অস্ত্র আসলে একজনের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন করে দিতে পারে। যখনই তুমি এটা হাতে নেবে তখনই তুমি অনুভব করবে তুমি একজন ভিন্ন মানুষ। অন্য মানুষ থেকে তোমার ক্ষমতা বেশি। তুমি নিজে ভেতরে এক ধরনের নতুন আত্মবিশ্বাস অনুভব করবে। নতুন ক্ষমতা অনুভব করবে।
য়ুহা আবার মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার এই আত্মবিশ্বাসের দরকার নেই। ক্ষমতারও দরকার নেই। যে ক্ষমতার অনুভূতির জন্যে হাতে অস্ত্র নিতে হয় আমার সেই অনুভূতির প্রয়োজন নেই।
হিসান হেসে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি একজন কবি। সব রকম অভিজ্ঞতাই তোমার কাছে মূল্যবান।
সেটা সত্যি, সব অভিজ্ঞতাই আমার কাছে মূল্যবান। তবে কিছু অভিজ্ঞতা আমি এগিয়ে গিয়ে গ্রহণ করি, কিছু অভিজ্ঞতা থেকে পালিয়ে চলে আসি। হাতে অস্ত্র রাখাটা সে রকম একটা অভিজ্ঞতা।
কেন?
আমার মনে হয় অস্ত্র খুব বুঝি অশুচি একটা জিনিস। মনে হয় এটা হাতে নিলে আমিও বুঝি অশুচি হয়ে যাব।
হিসান তার নিজের অস্ত্রটি হাতবদল করে খুব অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল।
য়ুহা যদিও বলেছিল সে কিছুতেই অস্ত্র হাতে নেবে না কিন্তু দেখা গেল সত্যি সত্যি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সে কার্গো বেতে অপেক্ষা করছে। অন্য কিছু দেখুক আর না-ই দেখুক এগারোজন বন্দীকে তার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে অস্ত্র ছাড়া কারো সেখানে যাবার কথা নয়।
শেষ পর্যন্ত এগারোজন বন্দী হেঁটে হেঁটে কার্গো বে’তে এসেছে তখন য়ুহা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল মানুষগুলো নেহায়েতই নিরীহ ধরনের। কয়েকজন মধ্যবয়স্ক, পোড় খাওয়া চেহারা, অন্যরা কমবয়সী। দু-একজন বয়সে প্রায় কিশোর। চারজন নানা বয়সী মেয়ে, এর মাঝে একজনকে আলাদা করে চোখে পড়ে, চেহারার মাঝে এক ধরনের কমনীয়তা রয়েছে, দেখে মনেই হয় না সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে। য়ুহা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন এবকে জিজ্ঞেস করল, এরা সবাই যোদ্ধা?
হ্যাঁ।
এরা সবাই বিদ্রোহী দলের?
হ্যাঁ।
এরা কোথায় ধরা পড়েছে?
একটা স্কাউটশিপ করে বায়োডোম আক্রমণ করতে এসেছিল। অসাধারণ যুদ্ধ করেছে।
যুদ্ধে কি কেউ মারা গেছে?
হ্যাঁ, অনেকে মারা গেছে। এদের মারা গেছে ছয়জন।
এখন এদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
ক্যাপ্টেন ক্রব য়ুহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, বলার নিয়ম নেই।
নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নেয়া হচ্ছে। তাই না?
সম্ভবত।
মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সব তথ্য বের করা হবে?
সম্ভবত।
এরা আর কখনোই মুক্তি পাবে না?
সম্ভবত না।
য়ুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি কি এদের সাথে কথা বলতে পারি?
ক্যাপ্টেন ত্ৰুব য়ুহার দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস, তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?
আমি ঠিক জানি না।
তারা তোমার কথার উত্তর দেবে না। শুধু শুধু চেষ্টা করো না।
তবুও, আমি কি তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে পারি?
ক্যাপ্টেন ক্রুব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে যাও। কিন্তু মনে রেখো আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম।
য়ুহা তখন বন্দীদের দিকে এগিয়ে গেল। এগারোজন বন্দী কার্গো বে-এর খোলা জায়গাটিতে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, য়ুহী একটু এগিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা কেমন আছ?
মানুষগুলো খানিকটা অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকালো, কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা আবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ তোমরা?
এবারেও কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন করেছি, তোমরা কেমন আছ?
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, আমাদের বিরক্ত করো না, যদি কিছু করার না থাকে তাহলে জাহান্নামে যাও।
য়ুহার চোখে-মুখে বেদনার একটা ছায়া পড়ল, সে বলল, আমি জানি তোমরা এখন খুব দুঃসময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছ, তার মানে এই নয় যে তোমরা অকারণে রূঢ় হবে।
কমবয়সী একজন ব্যঙ্গ করে বলল, আহা হা! সোনামণি মনে কষ্ট পেয়েছে। আস, আস! কাছে অস, তোমার গালে একটা চুমু দিই।
এবারে বন্দীদের সবাই শব্দ করে আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে উঠল। য়ুহা আহত গলায় বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমরা এবং তোমরা একই মানুষ। তোমাদের জন্যে আমাদের সম্মানবোধ থাকবে ঠিক সে রকম আমাদের জন্যে তোমাদের সম্মানবোধ থাকতে হবে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি এবার গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি জাহান্নামে যাও ছেলে। দূর হও এখান থেকে।
রুহা আহত দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখে মনে হয় তার চোখে পানি এসে যাবে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, ঠিক বলতে পারল না। তখন বন্দীদের ভেতরে কমনীয় চেহারার মেয়েটা বলল, ছেলে, তুমি একটা জিনিস মনে হয় ধরতে পারনি।
য়ুহা বলল, আমার নাম য়ুহা।
য়ুহা। তুমি মনে হয় একটা জিনিস–
আমি আমার নাম বলেছি। তোমারও উচিত তোমার পরিচয় দেওয়া।
আমার নাম রায়ীনা।
তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম রায়ীনা।
মেয়েটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, য়ুহা, তুমি একটা জিনিস এখনো ধরতে পারিনি। আমরা আর তোমরা এক মানুষ নই। তোমাদের সবার ঘাড়ে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে। তোমরা আর কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের সবাইকে শীতলঘরে ঢুকিয়ে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে একটা জড়বস্তুতে পাল্টে দেবে। আমাদের আর কখনো জাগিয়ে তোলা হবে কি না জানি না। যদি জাগিয়ে তোলাও হয় সেটা কত শত বৎসর পরে হবে আমরা সেটা জানি না। কাজেই এই সময়টুকু আমাদের একান্তই নিজস্ব সময়। আমাদের এটা ব্যবহার করতে দাও। যদি তুমি সত্যিই মনে করো আমাদের সম্মান দেখাবে তাহলে আমাদের একলা থাকতে দাও। বুঝেছ?