য়ুহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, না, আমি আসল য়ুহা না।
কেন?
আসল য়ুহা একজন কবি। সে শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে কবিতা লিখতে পারত। আমি পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি আমি শব্দের পাশে শব্দ আর বসাতে পারি না।
রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, আসল রায়ীনা মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর গবেষণা করত। কুরিত্রা সমীকরণের সহগগুলো সে মনে মনে হিসাব করে বের করতে পারত। আমি পারি না।
য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের মতো দুঃখী আর কেউ নেই। তাই না রায়ীনা?
রায়ীনা মাথা নাড়ল। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব রায়ীনা।
মহাকাশের এই প্রাণীটা যেন আমাদের মতো কাউকে নিয়ে এ রকম নিষ্ঠুরত্ত করতে না পারে সেটা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। মহাকাশযানটি এখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল বলে সে মহাকাশের সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমরা প্রাণীটিকে হত্যা করতে পারব না–কিন্তু সে যেন আর বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে সেটা তো নিশ্চিত করতে পারি।
আমরা কী পারব?
পারব। আগে আমরা কখনো আমাদের প্রাণের ঝুঁকি নিইনি। এখন আমাদের প্রাণের কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা এখন নিরাপদ স্কাউটশিপে করে মহাকাশযানে যাচ্ছি। আমাদের শুধু দুটি দেহ এই গ্রহে রয়ে গেছে। আমার আর তোমার এই দেহ দুটির কোনো মূল্য নেই।
১৯. ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণ
মহাকাশযানের সবাই সবিস্ময়ে দেখল ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণে কুৎসিত কালো গ্রহটির শক্তিশালী এন্টেনাটি উড়ে গেছে। মহাকাশযানের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সাথে সাথেই কুৎসিত কালো গ্রহের সেই মহাজাগতিক প্রাণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গেল। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নিজে থেকে একবার চালু নেয়ার সাথে সাথে, মহাকাশযানের ভেতরে আলো জ্বেলে ওঠে। শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে। মহাকাশযানটি নিজ অক্ষের ওপর ঘুরতে শুরু করার সাথে সাথে কৃত্রিম মহাকর্ষে ভেসে থাকা সবকিছু নিচে নেমে আসে। মহাকাশচারীরা অনেক দিন পর হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে।
য়ুহা আর রায়ীনার সম্মানে এবং তাদের প্রতি গভীর ভালোবাসায় যে ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের ক্রু এবং বিদ্রোহী দলের সদস্যরা পাশাপাশি বসে পানাহার করছিল। সেখানে মহাকাশযানের বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে রাখা সত্যিকার ভেড়ার মাংস, জৈবিক যবের রুটি এবং প্রাকৃতিক আঙুরের রসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মহাজাগতিক সিম্ফোনির সপ্তম অংশটি শুনতে শুনতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের ক্রু এবং বিদ্রোহী দলের সদস্যরা একে অন্যের সাথে হাসি তামাশায় মেতে উঠেছিল। উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে তরল কণ্ঠে তাদের কথাবার্তা পুরো মহাকাশযানে একটা অন্য ধরনের আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের কালো কুৎসিত গ্রহটার একটা বড় পাথরের পাশে য়ুহা এবং রায়ীনার দেহ দুটি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। য়ুহা তার হাতের অস্ত্রটির ট্রিগারে হাত দিয়ে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রায়ীনা।
রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি। আমি আর তুমি তো সত্যিকারের য়ুহা নই, সত্যিকারের রায়ী নই। আমরা হচ্ছি তাদের জোড়াতালি দেয়া দেহ! আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই য়ুহা। তার পরেও চলে যেতে আমার খুব কষ্ট লাগছে।
য়ুহা রায়ীনাকে গভীর মমতায় আলিঙ্গন করে বলল, আমাকে বিদায় দাও রায়ীনা।
রায়ীনা য়ুহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বিদায় দিতে পারল না। ধীরে ধীরে তার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়, য়ুহার ছেলেমানুষী মুখটা যখন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে তারা ট্রিগার টেনে ধরে।
বায়ুমণ্ডল নেই বলে গুলির শব্দটি গ্রহের ভেতর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে পারেনি।
———