ঠিক এ রকম সময় বড় একটা পাথরের আড়াল থেকে একটা প্রাণী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ে যায়। সাথে সাথে নানা আকারের আরো কিছু প্রাণী তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হুঁটোপুটি খেতে থাকে। য়ুহা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে হাত দিয়ে প্রাণীগুলো নিজের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, প্রাণীগুলো তাকে জাপটে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করতে থাকে। য়ুহা হাত দিয়ে প্রাণীগুলোকে আঘাত করার চেষ্টা করল, নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
হেডফোনে রায়ীনার গলার স্বর শুনতে পেল য়ুহা, আসছি। আমি আসছি!
য়ুহাকে যখন টেনেহিঁচড়ে বেশ কিছুদূর নিয়ে এসেছে তখন রায়ীনা দৌড়ে তার কাছে পৌঁছালো। হাতের অস্ত্রটি দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে গুলি করতে করতে সে ছুটে এসেছে। পেছন থেকে একটা প্রাণীকে টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, অস্ত্রটা দিয়ে সেটাকে আঘাত করে, তার পরেও সরাতে না পেরে সে আবার গুলি করল।
গুলির আঘাতে প্রাণীটা ছিটকে পড়ে গেল, কর্কশ এক ধরনের শব্দ করতে করতে সেটি উঠে দাঁড়ায়, তারপর উবু হয়ে উঠে সেটি হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। রায়ীনা য়ুহাকে টেনে নিয়ে যাওয়া বিচিত্র প্রাণীগুলোর দিকে অস্ত্রটা তাক করে গুলি করল এবং তখন হঠাৎ প্রাণীগুলো য়ুহাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করল।
প্রাণীগুলো পালিয়ে যাবার পর য়ুহা উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, তোমাকে ধন্যবাদ রায়ীনা। তুমি না এলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
তুমি ঠিক আছ তো?
হ্যাঁ। ঠিক আছি।
তাহলে চল, স্কাউটশিপে।
এক সেকেন্ড দাঁড়াও- য়ুহা হঠাৎ নিচু হয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, এই দেখো কী পড়ে আছে।
রায়ীনা এগিয়ে যায়, কী পড়ে আছে?
একটা হাত। তোমার গুলিতে প্রাণীটার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
রায়ীনা নিচু হয়ে হাতটা তুলে নেয়, সেটা তখনো নড়ছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হাতটা মানুষের হাত।
১৪. স্কাউটশিপের ভেতরে ছোট টেবিল
স্কাউটশিপের ভেতরে ছোট টেবিলটার ওপর মানুষের একটা হাত, সেটি শুকিয়ে অস্থিচর্মসার হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও বুঝতে এতটুকু সমস্যা হয় না যে হাতটি মানুষের। রায়ীনার গুলিতে হাতটি শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে কিন্তু যে ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারছে না সেটি হচ্ছে যে হাতটি এখনো জীবন্তু। তার আঙুলগুলো নড়ছে এবং মাঝে মাঝেই সেটা উল্টে যাওয়ার চেষ্টা করে। যতবার এটা উপুড় হয়েছে ততবার সেটা তার আঙুলগুলো দিয়ে খামচে খামচে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, ধরে ফেলার মতো কোনো কিছু পেলে হাতটা সেটা শক্ত করে ধরে ফেলে এবং তখন সেটাকে ছুটিয়ে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়। য়ুহা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এই কাটা হাতটির দিকে তাকিয়ে থাকে, আঙুল দিয়ে খামচে খামচে সেটা টেবিলের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, য়ুহা হাত দিয়ে ঠেলে সেটাকে টেবিলের মাঝামাঝি এনে বলল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না একটা হাত কেমন করে জীবন্ত থাকে।
রায়ীনা কোনো একটা ভাবনায় ড়ুবে ছিল, এবারে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা হাত আলাদাভাবে জীবন্ত থাকে না।
এই যে থাকছে। নাড়াচাড়া করছে।
রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, নাড়াচাড়া করে মানে জীবন্ত থাকা নয়! অনেক রকেট, মহাকাশযান, বাইভার্বাল নাড়াচাড়া করে, তার মানে এই নয় যে সেগুলো জীবন্ত।
তুমি বলছ এটা জীবন্ত না?
আমার তা-ই ধারণা।
তাহলে এটা কেমন করে নড়ছে?
এটাকে নাড়ানো হচ্ছে।
কে নাড়াচ্ছে? কীভাবে নাড়াচ্ছে?
রায়ীনা মুখে হাসি টেনে বলল, এতক্ষণ পর তুমি একটা সত্যিকারের প্রশ্ন করেছ। কে নাড়াচ্ছে এবং কীভাবে নাড়াচ্ছে। আমাদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ–
রায়ীনা মাথা নাড়ল, আমি আসলে এখনো কিছুই বলতে চাইছি না। তবে তুমি যদি খুব বিরক্ত না হও তাহালে খানিকক্ষণ জোরে জোরে চিন্তা করতে পারি।
করো। জোরে জোরে চিন্তা করো, তোমার চিন্তাটা শুনি।
তোমাকে যখন প্রাণীগুলো আক্রমণ করল তখন সেখানে আবছা অন্ধকারে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, তার পরেও মনে হচ্ছিল প্রাণীগুলোর হাত-পা আছে, শরীর আছে, মাথা আছে। মাথায় নাক মুখ চোখ আছে কী না আমরা এখনো জানি না। অন্ধকারের মাঝে গুলি করে শরীরের একটা অংশ আমরা আলাদা করে ফেলেছি—সেটা হচ্ছে একটা হাত। কাজেই মোটামুটি নিশ্চিত যে প্রাণীগুলো আসলে মানুষের আকৃতির।।
তার মানে তুমি বলছ এখানে মহাজাগতিক প্রাণী নেই, আছে মানুষ–
রায়ীনা বলল, আমি যখন তোমার সাথে কথা বলব তখন তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারবে। এখন আমি চিন্তা করছি। চিন্তার ভেতরে কেউ প্রশ্ন করতে পারে না!
ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কর। আমি আর প্রশ্ন করব না।
হাতটা যেহেতু মানুষের, তার মানে শরীটাও মানুষের। কিন্তু আমরা জানি মানুষের শরীর অত্যন্ত কোমল একটা জিনিস। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, নির্দিষ্ট চাপ এবং সুনির্দিষ্ট পরিবেশ না থাকলে সেটা বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে কিছুক্ষণ পরপর খেতে হয়। তাকে প্রতি মুহূর্তে ফুসফুসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন নিতে হয়, সেটা রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে দিতে হয়—এ রকম নানা ধরনের ঝামেলা আছে।
রায়ীনা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা জানি এই গ্রহটির তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই এবং যেটুকু আছে সেখানে অক্সিজেনের কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের দুজনকে দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই গ্রহটিতে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের কী বেটপ একটা পোশাক পরে থাকতে হচ্ছে কিন্তু এই মানুষগুলোর কোনো পোশাক নেই—বাতাসবিহীন, অক্সিজেনবিহীন শীতল একটা গ্রহে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সেটা হতে পারে শুধু একটি উপায়ে–