প্রথম কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই য়ুহা এবং রায়ীনার ভেতরে এক ধরনের। ক্লান্তি এসে ভর করল, কোনো কিছু না করার এক ধরনের ক্লান্তি আছে, সেই ক্লান্তি খুব সহজেই একজনকে কাবু করে ফেলে। য়ুহা বলল, এই ছোট স্কাউটশিপে বসে থাকতে অসহ্য লাগছে! আমি কি স্কাউটশিপের বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসতে পারি? অপরিচিত একটা গ্রহে পা দিতে কেমন লাগে সেটা একটু দেখতে চাই! কখনো এ রকম একটা অভিজ্ঞতা হবে আমি ভাবিনি।
রায়ীনা বলল, আমারও অসহ্য লাগছে, কিন্তু এক সাথে দুজন বের হওয়া ঠিক হবে না। তুমি বের হও আমি তোমার ওপর চোখ রাখি, তারপর আমি বের হব, তখন তুমি আমার ওপর চোখ রাখবে।
য়ুহা তখন খুব সাবধানে স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে এলো। তার শরীরে তাপ নিরোধক পোশাক, তারপরও বাইরের শীতল গ্রহটিতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। য়ুহা উপরের দিকে তাকালো, সেখানে কুচকুচে কালো আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। চারদিকে এবড়ো থেবড়ো পাথর, শুষ্ক এবং বিবর্ণ। য়ুহা স্কাউটশিপটি ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ তার ভেতরে এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতি হতে থাকে, তার মনে হয় কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো, আবছা অন্ধকারে উঁচু-নিচু পাথর, তার ভেতর থেকে সত্যিই কি কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে?
য়ুহা।
বল।
আমার মনে হচ্ছে তোমার হৃৎস্পন্দন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। কিছু কী হয়েছে?
না। কিছু হয়নি।
তুমি কী কোনো কারণে ভয় পেয়েছ?
না ভয় পাইনি। তবে—
তবে কী?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মানুষের মন খুব বিচিত্র। রায়ীনা হাসির মতো শব্দ করে বলে, সত্যি সত্যি কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি একটু চিন্তিত হতাম কিন্তু এটা যদি তোমার একটা কল্পনা হয়ে থাকে তাহলে আমি ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দেব না।
য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো, চারপাশে শুষ্ক বিবর্ণ পাথর, কোথাও কিছু নেই। য়ুহা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দেয়। মহাকাশের এই বিশেষ পোশাকে অভ্যস্ত হতে সময় নেবে, য়ুহা সাবধানে আর কয়েক পা অগ্রসর হয়। হাঁটা বলতে যা বোঝায় এটা মোটেও সে রকম নয়—গ্রহটার মাধ্যাকর্ষণ এত কম যে পায়ের ধাক্কাতেই অনেকটুকু উপরে উঠে যায়, মনে হয় সে বুঝি হেঁটে যাচ্ছে না, লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। শরীরের ভরকেন্দ্রটিও ঠিক জায়গায় নেই, পেছনে নানা ধরনের বোঝা, তাই একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে। এই পোশাকের সাথে একটা জেট প্যাক লাগানো আছে, সুইচ টিপেই সে উপরে উঠে যেতে পারবে, সামনে-পেছনে যেতে পারবে। য়ুহা এই মুহূর্তে সেটা অবশ্যি পরীক্ষা করে দেখার সাহস পেল না। এই পোশাকের সাথে একটা অস্ত্র ও থাকার কথা। অস্ত্রটা কোথায় আছে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটাও সে বুঝতে পারছে না। মনে মনে আশা করে আছে তাকে কখনোই অস্ত্রটা হাতে তুলে নিতে হবে না। পৃথিবীতে একটা জিনিসকেই সে অপছন্দ করে, সেটা হচ্ছে অস্ত্র।
যুহ অন্যমনস্কভাবে আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতেই রায়ীনার একটা সতর্কবাণী শুনতে পেল, য়ুহা, তুমি আর সামনে যেয়ো না।
কেন?
কোনো কারণ নেই। স্বাভাবিক নিরাপত্তার নিয়ম হচ্ছে অচেনা জায়গায় বেশি দূর না যাওয়া।
য়ুহা বলল, ঠিক আছে। আমি ফিরে আসছি।
য়ুহা ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে আবিষ্কার করল মহাকাশ অভিযানের এই বেঢপ পোশাক পরে খুব সহজ কাজগুলোও মোটেও সহজে করা যায় না। কোনোভাবে তাল সামলানোর চেষ্টা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ করে তার মনে হলো কিছু একটা যেন সরে গেছে। য়ুহা থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে তাকালো, সাথে সাথে সে রায়ীনার গলার স্বর শুনতে পায়, কী হয়েছে?
না কিছু না। তবে—
তবে কী?
আমার মনের ভুলও হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হলো কী একটা যেন সরে গেছে।
রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি বাইরে আর অপেক্ষা করে স্কাউটশিপে চলে এসো। রায়ীনা যদিও গলার স্বরটি শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে তার পরেও সেখানে উদ্বেগটুকু লুকিয়ে রাখতে পারল না।
আসছি। য়ুহা একটু এগিয়ে যেতেই দেখল অন্ধকার গ্রহের পাথরের আড়াল থেকে কিছু একটা দ্রুত সরে যাচ্ছে। সে আতঙ্কিতভাবে অন্যপাশে তাকালো, তার স্পষ্ট মনে হয় চারদিক থেকে কিছু একটা তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।
রায়ীনা।
কী হয়েছে?
আমার চারদিকে কিছু একটা এসেছে। মনে হয় কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।
তুমি তোমার মাথা ঠান্ডা রাখ য়ুহা। দৌড়ানোর চেষ্টা করবে না। ঠিক যেভাবে আসছিলে সেভাবে আসতে থাক। কোনো রকম বিপদ হলে আমি আছি।
ঠিক আছে।
য়ুহা স্কাউটশিপটার দিকে এগুতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার হেডফোনে কর্কশ একটা ধাতব শব্দ শুনতে পায়। অর্থহীন একটা শব্দ কিন্তু শব্দ সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। য়ুহার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে। মহাকাশের বেঢপ পোশাকের ভেতর সে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। য়ুহা আরো দুই পা এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ করে মনে হলো কোনো একটা প্রাণী খুব কাছে দিয়ে ছুটে গেছে, আবছা অন্ধকারে তার শরীরের খুঁটিনাটি কিছু দেখা গেল না। শুধু তার অস্তিত্বটা অনুভব করা গেল।
ভয় পেয়ো না য়ুহা। তুমি এগিয়ে আসতে থাকো-রায়ীনা তাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করল, তোমার কিছু হলে আমি আছি।
ঠিক আছে রায়ীনা।
য়ুহা আরো দুই পা এগিয়ে গেল, বড় কিছু পাথরের আড়ালে এখন স্কাউটশিপটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগিয়ে গেলেই সেখানে পৌঁছে যাবে। নিজের অজান্তেই য়ুহার পদক্ষেপ হঠাৎ দ্রুততর হয়ে ওঠে।