বুঝবে। তুমি নিঃসঙ্গতা বুঝবে। একা থাকার কী যন্ত্রণা তুমি সেটা খুব ভালো করেই বুঝবে। টেবিলের সামনে বসে থাকা মানুষটা য়ুহার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, যখন একজনের টুটি আরেকজন চেপে ধরতে চাইবে, তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।
য়ুহা বলল, সেটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। একজন কবির কাছে সেটারও একটা মূল্য আছে।
য়ুহা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, মানুষটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তুমি এখন পাশের ঘরে যাও। তোমার শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
য়ুহা উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের দিকে রওনা দিল।
মহাকাশ একাডেমি থেকে য়ুহা যখন বের হয়েছে তখন দুপুর হয়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর এবং বেশ তীব্র রোদ। মুহ। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মহাকাশে মানুষ যেখানেই বসতি তৈরি করেছে সেখানে নীল আকাশ তৈরি করেছে, সূর্য তৈরি করেছে। এই সব আসলে কৃত্রিম, আসল পৃথিবীর আসল আকাশ আর সেই আকাশে জ্বলজ্বলে প্রখর সূর্য না জানি কী রকম! পৃথিবীর নির্বোধ মানুষেরা সেই গ্ৰহটাকে নষ্ট না করে ফেললে এখনো তো মানুষেরা সেখানে থাকতে পারত। আবার কি কখনো পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?
০২. কমান্ডার একটু অবাক
কমান্ডার একটু অবাক হয়ে এগারোজন মানুষের দিকে তাকিয়ে রইল, গত কয়েক দিনের অবরোধে ছয়জন মারা গেছে, তা না হলে এখানে সতেরোজন থাকত। মাত্র সতেরোজন মানুষ ছোট একটা স্কাউটশিপে করে এসে পুরো বায়োডোমের অস্তিত্বটাই প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। একটা ছোট ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে রাখা এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে কেউ কি অনুমান করতে পারবে এরা কত দুর্ধর্ষ, কত সুশৃঙ্খল, নিজেদের আদর্শের জন্যে কত আন্তরিক? এ রকম বিদ্রোহী দলকে কি কখনোই পুরোপুরি পরাস্ত করা যাবে?
কমান্ডার একটা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের দলপতি কে?
মানুষগুলো তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না, এক ধরনের ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কমান্ডার বলল, আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ, তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি, গালের চামড়াটা নির্মমভাবে ঘষতে ঘষতে পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, মিছি মিছি সময় নষ্ট করো না। আমাদের নিয়ে কী করতে চাও করে ফেল।
তুমি যদি জিজ্ঞেস করো আমি কী করতে চাই তাহলে আমি কী বলব জান?
মানুষগুলো ভাবলেশহীন চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না। কমান্ডার তখন নিজেই বলল, আমি বলব যে, আমি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে চাই। সত্যি কথা বলতে কী ছেড়ে দেবার আগে তোমাদের সবাইকে নিয়ে একবেলা খেতে চাই। খাঁটি যবের রুটি, মসলা মাখানো ঝলসানো তিতির পাখির মাংস, আঙুরের রস-
মধ্যবয়স্ক মানুষটা বিরক্ত গলায় বলল, ফালতু কথা বলো না। আমাদের নিয়ে কী করতে চাও করো। মারতে চাইলে মেরে ফেক, আফা চুকে যাক।
কমান্ডার জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, মেরে ফেলাটা তো সবচেয়ে সহজ, তোমাদের জন্যেও সহজ, আমাদের জন্যেও সহজ। কিন্তু এত সহজে কি কাউকে মারা যায়? তোমাদের যে ছয়জন মারা গেছে তাদের মস্তি
ও এর মাঝে কয়োজেনিক চেম্বারে রেখে দেয়া হয়েছে। তাদের সাথেও যোগাযোগ করা হবে। তোমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, তোমাদের মস্তি স্কের প্রত্যেকটা নিউরনকে ওলটপালট করে দেখা হবে সেখানে কী আছে! কমান্ডার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বিষয়টা আমার হাতে নেই। যদি আমার হাতে থাকত তাহলে আমি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম। ছেড়ে দেবার আগে তোমাদের সবাইকে উষ্ণ সুগন্ধী পানিতে গোসল করার সুযোগ করে দিতাম। গোসল করে তোমরা ভাজভাঙা নিও পলিমারের কাপড় পরতে-
মধ্যবয়স্ক মানুষটা হিংস্র গলায় বলল, ফালতু কথা বলো না। তোমার ফালতু কথা শুনে আমার বমি এসে যাচ্ছে।
কমান্ডার মাথা নাড়ল, বলল, আমি দুঃখিত। আমি খুবই দুঃখিত যে আমার একেবারে আন্তরিক কথাগুলোকেও তোমার কাছে ফালতু কথা মনে হচ্ছে! শুধু যে ফালতু মনে হচ্ছে তা-ই না, কথাটা শুনে তোমার বমি এসে যাচ্ছে। যা-ই হোক, আমি তাহলে আর কথা বলব না। তোমাদের সাথে কথা বলার জন্যে, তোমাদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে বিশেষ বাহিনীই আছে। তারাই বলবে। তবে আমি আগের থেকে তোমাদের সাবধান করে দিই, তাদের পদ্ধতিটা কিন্তু তোমাদের ভালো লাগবে না। একেবারেই ভালো লাগবে না।
কমান্ডার ছোট ঘরটা থেকে বের হতে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল, গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি জানি আমার কথাগুলো শুনতে তোমাদের খুবই বিরক্তি লাগছে, তারপরেও আমাকে বলতেই হবে, তোমরা অসম্ভব ভালো যুদ্ধ করেছ। আমি মুগ্ধ হয়েছি। এত অল্প যোদ্ধা দিয়ে যে এ রকম একটা অপারেশন করা যায় সেটা অবিশ্বাস্য।
ছোট ঘরের মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। কমান্ডার তাদের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কোনায় বসে থাকা একটা কমবয়সী মেয়ের দিকে তাকালো, বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না, মেয়ে, তুমিও কি যুদ্ধ করছিলে?
মেয়েটি অন্যমনস্কভাবে সামনে তাকিয়ে ছিল, কমান্ডারের কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো, বলল, তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছ?