হ্যাঁ। ছেড়ে দেবে। অবশ্যই ছেড়ে দেবে—
কোন যুক্তিতে?
য়ুহা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, কারণ আমরাও মানুষ, তারাও মানুষ। একটা মহাজাগতিক প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমরা মানুষেরা এক সাথে থাকব! আমাদের পার্থক্যের কথা আমরা ভুলে যাব-
ক্যাপ্টেন ক্ৰব শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা অত্যন্ত আজগুবি প্রস্তাব। এ ধরনের কিছু করা হলে সামরিক কমান্ডে আমাকে বিচার করা হবে।
না, করা হবে না। এতগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তোমাকে পদক দেয়া হবে।
না। হবে না। আমি সামরিক কমান্ডের মানুষ—আমি জানি। আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হয়।
য়ুহা চিৎকার করে বলল, তোমার নিয়মের আমি নিকুচি করি! আগে মানুষের জীবন তারপর জীবন।
ক্যাপ্টেন ত্রুব কঠিন মুখে বলল, না। সবার আগে নিয়ম।
য়ুহা কাতর গলায় বলল, দোহাই লাগে তোমায় ক্যাপ্টেন ক্ৰব, এগারোজন যোদ্ধাকে তুমি শীতলঘরে শীতল করে রেখেছ! তাদের ব্যবহার কর।
না। ক্যাপ্টেন ত্রুব মাথা নেড়ে বলল, য়ুহা। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আর কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। আমার ক্রুরা এই মুহূর্তে মহাকাশযানের নির্দিষ্ট জায়গায় বিস্ফোরক লাগাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব হাতে ধরে রাখা একটা সুইচ দেখিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে আমি এই সুইচ টিপে পুরো মহাকাশযানটি উড়িয়ে দেব। আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তটি একটু একা থাকতে চাই। নিজের সাথে শেষ বোঝাঁপড়া করতে চাই।
য়ুহা স্থির দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকিয়ে ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভরশূন্য পরিবেশে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, য়ুহা একেবারেই পারে না, তাকে এক জায়গায় থাকার জন্যে এটা-সেটা ধরতে হয়—একটু আগে একটা ভাসমান ধাতবদণ্ড ধরেছে, সেটা এখনো তার হাতে আছে। য়ুহা একবার ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকালো তারপর তার হাতের দণ্ডটির দিকে তাকালো। তার মুখের মাংসপেশি হঠাৎ করে শক্ত হয়ে যায়। সে দুই হাতে শক্ত করে ধাতবদণ্ডটি ধরে রেখে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়ায়। তার এ জীবনে কখনোই কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলেনি—একজন মানুষকে কেমন করে আঘাত করতে হয় সে জানে না। বহুদিন আগে কোথায় শুনেছিল মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছাকাছি আগত করলে মানুষ নাকি অচেতন হয়ে যায়। য়ুহা তা-ই চেষ্টা করল, পুরো ঘটনাটি ঘটল চোখের পলাকে এবং অত্যন্ত স্থূল ভাবে, এ ধরনের ব্যাপারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় বলে আঘাত করার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সে নিজে শূন্যে হুঁটোপুটি খেতে থাকে। অনেক কষ্টে নিজেকে যখন সামলে নেয় তখন সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন ক্রলের অচেতন দেহ ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। তার হাতে এখনো শক্ত করে একটা সুইচ ধরে রাখা আছে, এই সুইচে কিছু গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে একটু পরে পুরো মহাকাশযানটিকে উড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল।
য়ুহা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের কাছে পৌঁছে তার হাতের মুঠি থেকে সুইচটা খুলে নেয়। সুইচটা পকেটে রেখে সে তার গলায় ঝোলানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটিও খুলে নিল। তারপর ক্যাপ্টেন ক্ৰকের দেহটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, মহাকাশযানের অসংখ্য জঞ্জালের ভেতর সেটিও ঘুরপাক খেতে খেতে ভাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।
এখন তাকে শীতলঘরে গিয়ে এগারোজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আগে সে কখনো এটা করেনি কিন্তু সেটা নিয়ে তার খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। আগে সে অনেক কিছুই করেনি। একটা ধাতবদণ্ড দিয়ে আঘাত করে সে আগে কখনো কোনো মানুষকে অচেতন করেনি।
০৯. ভরশূন্য পরিবেশে চলাচল
ভরশূন্য পরিবেশে চলাচল করার অভ্যাস না থাকার কারণে শীতল ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে য়ুহার বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। পাশাপাশি এগারোটা ক্যাপসুল সাজানো আছে, ভেতরে আবছা অন্ধকার, যন্ত্রপাতির মৃদুগুঞ্জন ছাড়া সেখানে কোনো শব্দ নেই।
য়ুহা ক্যাপসুলগুলো পরীক্ষা করে, কেমন করে এর ভেতরে শীতল হয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলা যাবে সে জানে না। তাকে বলা হয়েছে ক্যাপসুলগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজেই বাইরের সাথে যোগাযোগ কেটে দিলে ক্যাপসুল গুলো কোনো উপায় না দেখে নিশ্চয়ই ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে দেবে। বিষয়টা হয়তো বিপজ্জনক কিন্তু নিশ্চয়ই কার্যকর। য়ুহা হাতের অস্ত্রটি নিয়ে একটা একটা করে ক্যাপসুল পরীক্ষা করে রায়ীনার ক্যাপসুলের পাশে এসে দাঁড়াল। স্বচ্ছ ঢাকনার ভেতর দিয়ে রায়ীর শীতল দেহটি দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয় না এটি একটি জীবন্ত মানুষ, মনে হয় পাথরের ভাস্কর্য। য়ুহা ক্যাপসুলের পাশে সুইচগুলো পরীক্ষা করে, কোনো একটি লিভার টেনে কোনো একটা সুইচ টিপে দিলেই ভেতরের মানুষটি জেগে উঠবে সে রকম কিছু খুঁজে পেল না। তাই সে ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে যাওয়া নানা ধরনের টিউব, বৈদ্যুতিক তার, অপটিক্যাল ক্যাবলগুলো খুঁজে বের করল। যদি সে এগুলো কেটে দেয় তাহলে নিশ্চয়ই ক্যাপসুলটি পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়ে রায়ীনাকে জাগিয়ে তুলবে। বিষয়টি নিশ্চয়ই খুব বিপজ্জনক কিন্তু য়ুহার কিছু করার নেই। এই মহাকাশযানের প্রতিটি মুহূর্ত এখন প্রতিটি মানুষের জন্যে বিপজ্জনক।
য়ুহা হাতের অস্ত্রটি ক্যাবলগুলোর দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলঘরের ভেতর একটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়, কালো ধোঁয়া এবং আঁঝালো গন্ধে সারা ঘর ভরে ওঠে। য়ুহা কাশতে কাশতে একটু পেছনে সরে এলো। চেষ্টা করেছে ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে কিন্তু তারপরও সেটি পুরো ঘরটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরণের শব্দে কৌতূহলী হয়ে ক্রুরা এখানে চলে এলে একটা ঝামেলা হয়ে যাবে।