য়ুহা টলতে টলতে ছুটে যেতে থাকে ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের দিকে। বন্ধ দরজাটা সে গুলি করে ভেঙে ভেতরে ঢুকবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখবে
য়ুহা। কী করছ তুমি?
কেউ একজন পেছন থেকে ডাকছে কিন্তু য়ুহা পেছন ফিরে তাকালো না—এখন তার আর নষ্ট করার মতো সময় নেই। সে ছুটে যেতে থাকে।
য়ুহা।
রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা মৃত্যুর মাঝে রক্ত য়ুহা বিড়বিড় করে বলল, রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা…
ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে তার অস্ত্রটা তুলে ধরে ট্রিগার টেনে ধরল। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় চারদিকে। ধোয়াটা সরে গেলে য়ুহা দেখল যেখানে দরজাটা ছিল সেখানে বিশাল একটা বৃত্তাকার গর্ত হয়ে গেছে।
য়ুহা গর্তের ভেতরে দিয়ে ঘরটাতে ঢুকে জানালায় মুখ লাগিয়ে বাইরে তাকালো। কালো মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে কিন্তু এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটা দেখা যাচ্ছে না। ঠিক সামনেই এটা থাকার কথা ছিল, এটি নেই। মহাকাশযানটা ঘুরে গেছে বলে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
য়ুহা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে তাকালো, কমান্ডের লোকজন অস্ত্র উদ্যত করে তাকে ঘিরে রেখেছে। য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করনি। এখন তাহলে নিজের চোখেই দেখ। য়ুহা জানালা থেকে সরে গিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটা আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখ।
অবশ্যি তখন আর তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল না। পুরো মহাকাশযানটি হঠাৎ একবার ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। এতক্ষণ কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক পুরো বিষয়টা সবার কাছে গোপন রেখেছিল, এখন আর গোপন রাখার প্রয়োজন নেই।
০৮. কিছু বোঝার আগেই
কিছু বোঝার আগেই য়ুহা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় গড়িয়ে গেল, হাত দিয়ে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করল, পারল না, মহাকাশযানের দেয়ালে গিয়ে সে সজোরে একটা ধাক্কা খেল। পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে এটা বুঝি যে কোনো মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাবে। য়ুহা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, তীচ স্বরে একটা এলার্ম বাজছে। এলার্মের তীব্র শব্দটি শুনলেই মনে হয় বুৰিা ভয়ঙ্কর একটা বিপদ নেমে আসছে। একটা লাল আলো থেকে থেকে জ্বলে উঠছে, সেটা বুকের মাঝে একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। য়ুহা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। তার মনে হলো অদৃশ্য একটা শক্তি বুঝি তাকে দেয়ালে চেপে ধরে রেখেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকানোর চেষ্টা করল, মহাকাশযানের ভেতরে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কমান্ডের ক্রুরা চারদিকে ছিটকে পড়ছে। কেউ আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ভেতরে কর্কশ এক ধরনের ভয় জাগানো শব্দ, সেই শব্দ ছাপিয়ে ইঞ্জিনের চাপা গুম গুম শব্দ ভেসে আসছে। য়ুহা মহাকাশযানের দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটি একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো ঝটকা দিয়ে ওঠে, য়ুহা কিছু বোঝার আগেই দেখে সে শূন্যে ছিটকে উঠেছে—নিচে পড়ার আগেই সে অন্য পাশে ছুটে গেল—নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, পারল না। মুহূর্তেই তার চারপাশের জগৎটা অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে ড়ুবে যাবার আগে য়ুহার মনে হলো, তাহলে এটাই কি মৃত্যু?
ভয়ঙ্কর এক ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখছিল য়ুহা, পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে সে গড়িয়ে যাচ্ছে, নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। নিচে লকলক আগুন, সেই আগুনের প্রচণ্ড তাপে তার শরীরের চামড়া গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু প্রাণী তাকে ঘিরে ফেলেছে, শরীরটাকে ছিঁড়ে ছিড়ে খাচ্ছে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এর মাঝে ভাসা ভাসাভাবে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। তীব্র আলোর ঝলকানি, মানুষের আর্তচিৎকার আর ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সে আবার জ্ঞান হারিয়েছে। অচেতন অবস্থায় সে টের পেয়েছে তার দেহটা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছিটকে গেছে, আঘাতে আঘাতে তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।
য়ুহার জ্ঞান ফিরে পাবার পরও সে বুঝতে পারল না কোথায় আছে। চারপাশে অসংখ্য জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে, তার মাঝে সে নিজেও ভাসছে। য়ুহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে, সে কি হঠাৎ করে নিচে পড়বে, শরীরের সবগুলো হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবে? কিন্তু য়ুহা পড়ল না, সে মহাকাশযানের ভেতরে ভাসতে লাগল।
য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো, একটা লাল আলো একটু পরে পরে ঝলকানি দিচ্ছে কিন্তু সেই কর্কশ এলার্মের শব্দটি নেই। চারপাশে এক ধরনের নীরবতা, সেই ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ বুকের মাঝে এক ধরনের ভয়ের কাপুনি ছড়িয়ে দেয়। য়ুহা নিজের অজান্তেই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না কিন্তু হঠাৎ করে তার সারা শরীরটা বিচিত্রভাবে ওলটপালট খেতে থাকে। শরীরের কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর এক ধরনের বেদনা–কে জানে হাড়গোড় কিছু ভেঙেছে কি না। য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড়ে ব্যথাটুকু সহ্য করল। নিজেকে থামানোর জন্যে সে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল, হঠাৎ করে যেটা ধরল সেটা হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়–একজন মানুষের শীতল দেহ! রুহা ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠে চারদিকে তাকায়, সবাই কি মারা গেছে?
ঠিক এ রকম সময় রুহা মহাকাশযানের এক পাশে আলো হাতে কয়েকজনকে ভেসে যেতে দেখে। অত্যন্ত ব্যস্তভাবে দ্রুতগতিতে তারা ছুটে যাচ্ছে। য়ুহা তাদেরকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল, মানুষগুলো খুব ব্যস্ত, এখন হয়তো তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না। য়ুহা মহাকাশযানের ভেতরে অসহায়ভাবে ঝুলে আছে, সামনে-পিছে যেতে পারছে না। একজন ক্রুয়ের দেহ ভেসে ভেসে আসছে, সেটাকে টেনে ধরে সে ছেড়ে দিতেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালের কাছে পৌঁছাতেই সে শক্ত করে দেয়ালটা খামচে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। বাম হাতটা ব্যথায় টনটন করছে, মাথার ভেতরেও যন্ত্রণার এক ধরনের অনুভূতি দপ দপ করছে। য়ুহা সেই অবস্থায় দেয়ালটা ধরে নিচে নামতে থাকে।