তবে কী? আমরা যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, নিজের চোখে দেখার চেষ্টা করি তাহলে সেটা দেখব।
য়ুহা বলল, আমি জানি, ব্যাপারটা এক ধরনের ছেলেমা কৌতূহল। তবুও আমি একবার নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চাই।
হিসান হাসল, বলল, যাও। দেখে আস।
য়ুহা হেঁটে হেঁটে ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের কাছে এসে দেখে দরজাটি বন্ধ। সে দরজাটি খোলার চেষ্টা করল, খুলতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দেয়। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে দরজাটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
য়ুহা কী করবে বুঝতে না পেরে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসে। বিছানায় পা তুলে বসে সে খানিকক্ষণ চিন্তা করল। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না, বোঝার চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। সে আর সময় নষ্ট করবে না, সবকিছু ভুলে গিয়ে সে মহাকাশভ্রমণ উপভোগ করতে শুরু করবে। সে শুনেছিল মহাকাশ ভ্রমণে নাকি ভরশূন্য পরিবেশ হতে পারে, সে ক্যাপ্টেন ক্রবকে অনুরোধ করবে ভরশূন্য পরিবেশ তৈরি করতে। মিটিয়া। হলোগ্রাফিক ক্লিপগুলোর কথা বলেছিল সেগুলো দেখাবে। কোয়ও গোলকটা সে ছুড়ে ফেলে দেবে কোথাও!
বিছানা থেকে নামতেই হঠাৎ করে য়ুহার মাথাটা একটু ঘুরে গেল, আরেকটু হলে সে পড়েই যাচ্ছিল, কোনোভাবে বিছানাটা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। কী আশ্চর্য! কী হয়েছে তার?
টলতে টলতে একটু এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতে গিয়ে আবিষ্কার করল দরজাটা বন্ধ। য়ুহা কয়েকবার জোরে ধাক্কা দেয় দরজাটাকে, সেটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে আটকে আছে। য়ুহা অবাক হয়ে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঘরে খুব সূক্ষ্ম মিষ্টি এক ধরনের গন্ধ, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিছু একটা হয়েছে এই ঘরে। কী হয়েছে?
য়ুহা।
কেউ একজন তাকে ডাকছে, য়ুহা চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কেউ নেই, কে কথা বলে?
য়ুহা।
কে?
আমি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক।
তুমি কী চাও?
তোমার বিছানার মাথার কাছে তোমার অস্ত্রটা রাখা আছে। সেটা হাতে নাও।
কেন?
তুমি এখন আত্মহত্যা করবে।
য়ুহা চমকে উঠে বলল, কেন আমি আত্মহত্যা করব?
আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি তাই।
না। য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিছুতেই না।
কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হাসির মতো শব্দ করল, বলল, তোমার ঘরে আমি নিহিনক্স গ্যাস পাঠাচ্ছি। একটু পরেই তোমার নিজের ইচ্ছাশক্তি বলে কিছু থাকবে না। আমি যেটা বলব সেটাই হবে তোমার।
য়ুহা বিস্ফারিত চোখে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। সত্যি সত্যি তার কাছে মনে হচ্ছে কিছুতেই আর কিছু আসে-যায় না। তার কাছে মনে হতে থাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দেয়া চমৎকার একটা ব্যাপার।
মহাকাশযানের সবাই জানে কিছু একটা নিয়ে তুমি খুব বিক্ষিপ্ত। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ফিস ফিস করে বলল, কেউ যদি তোমার যোগাযোগ মডিউল দেখে, দেখাবে সেখানে তুমি অনেক বিভ্রান্ত কথা লিখেছ।
আমি লিখিনি।
কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নরম গলায় বলল, আমি লিখেছি। তোমার হয়ে আমি লিখেছি। নিঃসঙ্গ মহাকাশযানে বিভ্রান্ত একজন কবি এক ধরনের মানসিক চাপের মাঝে থেকে হঠাৎ করে আত্মহত্যা করেছে। এটা খুবই বিশ্বাসযোগ্য একটা ঘটনা।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বিশ্বাসযোগ্য।
তুমি এসো, অস্ত্রটি হাতে নাও।
য়ুহা টলতে টলতে এগিয়ে যায়। অস্ত্রটা হাতে নেয়।
কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ফিসফিস করে বলে, অস্ত্রটা তোমার মাথায় ধর য়ুহা। ট্রিগার টেনে ধর।
য়ুহা অস্ত্রটা মাথায় ধরে, ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, কিন্তু কেন?
তুমি আমার কাজকর্মে অসুবিধে করছ।
কিন্তু—কিন্তু–
ট্রিগারটা টানো য়ুহা।
ট্রিগার টানতে গিয়ে য়ুহা আবার থেমে গেল। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমাকে শুধু একটা কথা বল।
কী কথা?
তুমি সবাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
আমি জানি না। আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছে সে জানে।
কে তোমাকে নির্দেশ দিয়েছে?
অত্যন্ত বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী। যারা আমার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে আমার নির্দেশকে পাল্টে দিতে পারে। আমার এখন তার নির্দেশ মানতে হবে। আমি এখন তার নির্দেশ মানছি।
কিন্তু—কিন্তু–
ট্রিগারটা টানো য়ুহা।
ট্রিগারটা টানতে গিয়ে য়ুহা আবার থেমে গেল। তার ভেতরের কোনো একটা সত্তা তাকে বলছে, না, কিছুতেই না। কিছুতেই না।
টানো।
না। হা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, না। টানব না।
কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হাসির মতো শব্দ করল, বলল, তুমি টানবে য়ুহা! অবশ্যই ট্রিগারটা টানবে। নিহিনক্স গ্যাস তোমার চেতনাকে যখন আরেকটু দুর্বল করবে তখন তুমি ট্রিগারটা টানবে।
য়ুহা অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রাখে। তার মাথার মাঝে একটা কবিতার লাইন এসেছে, রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা মৃত্যুর মাঝে রক্ত-
টানো।
য়ুহা ট্রিগার টানল, কিন্তু টানার ঠিক আগের মুহূর্তে অস্ত্রটা দরজার দিকে ঘুরিয়ে নিল। প্রচণ্ড একটা শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়, ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে যায়। খক খক করে কাশতে কাশতে য়ুহা দেখল একটু আগে যেখানে দরজাটা ছিল সেখানে একটা বিশাল গর্ত। য়ুহা হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটা দিয়ে বের হতে চেষ্টা করে। কে যেন পেছন থেকে ডাকছে, য়ুহা। য়ুহা। শোন য়ুহা।
কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে য়ুহা উঠে দাঁড়ায়, কোনো কিছু সে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। চারপাশে যা ঘটছে সেগুলো যেন অতিকৃতিক ঘটনা। সবকিছু যেন পরাবাস্তব। টলতে টলতে সে দুই পা এগিয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে কমান্ডের সবাই ছুটে আসছে, তারস্বরে একটা এলার্ম বাজতে শুরু করেছে কোথাও।